সুরাটে পাঁচ হাজারের বেশি কারখানায় বিশ্বের ৯০ শতাংশ হীরা প্রক্রিয়াজাত করা হয়
সুরাটে পাঁচ হাজারের বেশি কারখানায় বিশ্বের ৯০ শতাংশ হীরা প্রক্রিয়াজাত করা হয়

হীরা পলিশের রাজধানীতে কর্মীরা কেন ‘আত্মহত্যা’ করছেন

বিশ্বে হীরা পলিশ করার ‘রাজধানী’ পশ্চিম ভারতের সুরাট। এই পলিশকাজের কর্মী ছিলেন নিকুঞ্জ ট্যাংক। গত মে মাসে তিনি কাজ হারান। এরপর তিনি অনেকটা মরিয়া হয়ে ওঠেন।

সাত বছর ধরে নিকুঞ্জ যে কারখানাটিতে (ইউনিট) কাজ করেছিলেন, তা আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়। একপর্যায়ে কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে তিনিসহ তাঁর আরও অনেক সহকর্মী বেকার হয়ে পড়েন।

নিকুঞ্জ ছিলেন তাঁর পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি। তিনি তাঁর মা–বাবা, স্ত্রী-মেয়ের ভরণপোষণসহ যাবতীয় খরচ সামলাতেন। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর কোনো সঞ্চয় ছিল না।

নিকুঞ্জর অবসরপ্রাপ্ত বাবা জয়ন্তী ট্যাংক বলেন, ‘সে (নিকুঞ্জ) চাকরি খুঁজে না পেয়ে, এই ধকল সইতে না পেরে চরম পথ বেছে নেয়।’

গত আগস্ট মাসে আত্মহত্যা করেন নিকুঞ্জ।

কয়েক বছর ধরে ভারতের মন্দা-আক্রান্ত হীরাশিল্পের জন্য একটা কঠিন সময় যাচ্ছে।

সুরাটের অবস্থান ভারতের গুজরাট রাজ্যে। সুরাটে পাঁচ হাজারের বেশি কারখানায় (ইউনিট) বিশ্বের ৯০ শতাংশ হীরা প্রক্রিয়াজাত করা হয়। সুরাটে আট লাখের বেশি কর্মী হীরা পলিশকারী হিসেবে কাজ করেন।

শহরে ১৫টি বড় পলিশ কারখানা রয়েছে, যেগুলো বছরে ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যবসা (টার্নওভার) করে।

ভারতের কাটা ও পলিশ করা পাথরের (রত্ন) রপ্তানি ২০২২ সালে ছিল ২৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালে তা কমে ১৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। ২০২৪ সালে তা আরও কমে ১২ বিলিয়ন ডলার হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, কম চাহিদা ও অতিরিক্ত সরবরাহের কারণে ২০২৩ সালে পলিশ করা হীরার দাম অনেক (২৭ শতাংশ পর্যন্ত) কমেছে।

সুরাটের স্টার রত্নের মহেশ ভিরানি বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, অতিরিক্ত সরবরাহ ঘটেছে। কারণ, সীমিত চাহিদা থাকা সত্ত্বেও চালু থাকার জন্য পলিশ কারখানাগুলো উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে। এটি তাদের লোকসান বাড়িয়েছে।

রাজ্যের ডায়মন্ড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন বিবিসি গুজরাটিকে জানায়, মন্দার কারণে শুধু গত ছয় মাসে ৩০ হাজারের বেশি কর্মী চাকরি হারিয়েছেন।

পলিশকারীদের প্রতিনিধিত্বকারী এই ইউনিয়ন বলেছে, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পরিবার, পুলিশের নথি ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে সংগৃহীত তথ্য অনুসারে, এই মন্দার কারণে রাজ্যে গত দেড় বছরে ৬৫ জন শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন।

তবে ইউনিয়নের এই পরিসংখ্যান বিবিসি অন্যত্র যাচাই করতে পারেনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মহামারিকালের লকডাউন, রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ ও প্রধান প্রধান বাজারে চাহিদা কমে যাওয়া ভারতের হীরাশিল্পে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।

শীর্ষস্থানীয় প্রস্তুতকারক কিরণ রত্নের চেয়ারম্যান বল্লভ লাখানি বলেন, বিশ্বব্যাপী মন্দার কারণে পলিশ করা হীরার ব্যবসা ২৫-৩০ শতাংশের বেশি কমে গেছে।

ভারত তার অমসৃণ হীরার ৩০ শতাংশ রাশিয়ার খনি থেকে আমদানি করে। পরে সেগুলো কেটে পলিশ করে। এরপর বেশির ভাগই পশ্চিমা বাজারে বিক্রি করে। তবে ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

গত মার্চ মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জি-৭ দেশগুলো রাশিয়ার অমসৃণ (পলিশ করা নয়) হীরা আমদানির ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ভারতে প্রক্রিয়াজাত করা এবং তৃতীয় দেশের মাধ্যমে তা পশ্চিমা দেশে বিক্রি করার বিষয়টিও এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছে।

নতুন নিষেধাজ্ঞার পর ভারত প্রকাশ্যে উদ্বেগ জানিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর গত এপ্রিল মাসে বলেছিলেন, এ ধরনের পদক্ষেপ রাশিয়ার চেয়ে বরং সরবরাহব্যবস্থার নিচের দিকে থাকা লোকদের বেশি ক্ষতি করে। কারণ, উৎপাদকেরা সাধারণত বিকল্প পথ খুঁজে পায়।

সুরাটের ব্যবসায়ীরাও একই কথা বলছেন।

রপ্তানিকারক কীর্তি শাহ বলেন, হীরাশিল্পের যে ধাপগুলো, তার নিচের দিকে রয়েছে ভারত। কাঁচামাল ও চূড়ান্ত বিক্রয়—উভয়ের জন্যই ভারত বিশ্ববাজারের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল।

উপরন্তু জি-৭ দেশগুলোতেও অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। একই অবস্থা সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বেলজিয়ামের। এগুলো ভারতের রপ্তানির প্রধান গন্তব্যস্থল। ফলে ভারতের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

ব্যবসায় মন্দার আরেকটি কারণ গবেষণাগারে উৎপাদিত হীরার চাহিদা বৃদ্ধি। প্রাকৃতিক হীরার একটি সস্তা বিকল্প এটি। এ ছাড়া গাজা যুদ্ধও ব্যবসায় ক্ষতির জন্য দায়ী। কারণ, ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যের একটি বড় অংশে রয়েছে এই রত্ন।

গুজরাট রাজ্যের শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আইনপ্রণেতা কুমার কানানি বলেন, সুরাটের হীরা খাত একটা বাজে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। চাকরি হারানোর কারণে আত্মহত্যার ঘটনাগুলো পুলিশ তদন্ত করছে।

কুমার কানানি আরও বলেন, সরকার পলিশকারী, ব্যাপারী ও ব্যবসায়ীদের সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত।

আত্মহত্যা করেছেন—এমন অন্তত নয়জন শ্রমিকের পরিবার বলেছে, তারা সরকারের কাছ থেকে সামান্যই সাহায্য পেয়েছে।

সুরাটে বেশির ভাগ বন্ধ হয়েছে ছোট ও মাঝারি আকারের কারখানাগুলো। এই কারখানাগুলো সাধারণত অমসৃণ হীরার গুণমান পরীক্ষা করা, তা পলিশ করা ও কাঙ্ক্ষিত আকার-আকৃতি দেওয়ার জন্য শ্রমিকদের নিয়োগ দিয়ে থাকে।

তবে এই খাতের বড় ব্যবসায়ীদের ওপরও প্রভাব পড়েছে। গত মাসে কিরণ রত্ন তার ৫০ হাজার কর্মচারীকে ১০ দিনের ছুটিতে পাঠায়। কারণ হিসেবে তারা ব্যবসায় মন্দার কথা উল্লেখ করে।

গত জুলাই মাসে ডায়মন্ড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন একটি হেল্পলাইন চালু করে। এই হেল্পলাইনে চাকরি বা আর্থিক সাহায্য চেয়ে পলিশকারীদের কাছ থেকে ১ হাজার ৬০০টির বেশি কল আসে। কিন্তু এমন কিছু ব্যক্তি আছেন, যাঁরা সময়মতো সাহায্য-সহযোগিতা পাননি।

৩৮ বছর বয়সী বৈশালী প্যাটেল দুই বছর আগে তাঁর স্বামী নিতিনকে হারান। তিনি যে পলিশ কারখানায় কাজ করতেন, সেটি ব্যবসায় মন্দার কারণে বেশির ভাগ কর্মী ছাঁটাই করেছিল।

মন্দার কারণে ব্রোকার ও ব্যাপারীরাও বিপাকে পড়েছেন।

ব্রোকাররা গ্রাহক, ব্যাপারী ও অন্যদের কাছে হীরা বিক্রি করেন। সুরাটের পাঁচ হাজার ব্রোকারের একজন দিলীপ সোজিত্রা। তিনি বলেন, ‘আমরা কয়েক দিন ধরে অলস বসে আছি। খুব কমই কেনাবেচা হয়।’

পরীক্ষাগারে উৎপাদিত হীরারও একসময় বেশ চাহিদা ছিল। কিন্তু অতিরিক্ত উৎপাদনের কারণে এর দাম প্রতি ক্যারেটে ৩০০ থেকে কমে ৭৮ ডলারে নেমে এসেছে, যা বাজারে প্রভাব ফেলেছে।

সুরাট ডায়মন্ড ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নন্দলাল নাকরানি মনে করেন, অমসৃণ হীরার দাম কমে গেলে এবং পলিশ করা হীরার দাম বাড়লে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

মন্দা সত্ত্বেও কেউ কেউ আশা করছেন শিল্পটি আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে, যেমনটি ২০০৮ সালের মহামন্দার পর হয়েছিল। সেই মহামন্দার সময় শত শত পলিশ কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হাজার হাজার মানুষ বেকার হয়ে পড়েছিল।

সুরাটের দিলীপ সোজিত্রা বলেন, তিনি মনে করেন, দীপাবলি, ক্রিসমাস, নববর্ষসহ আসন্ন উৎসবের মৌসুম ব্যবসার গতি বাড়াতে সাহায্য করবে। এখনকার বাজে পরিস্থিতিও কেটে যাবে।