রায়বেরিলি ও ওয়েনাডের মধ্যে কোনটা রেখে কোনটা ছাড়বেন শুধু এই দোলাচলই নয়, রাহুল গান্ধীকে আরও একটি বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। লোকসভার বিরোধী নেতার পদ তিনি নেবেন কি না। ২৪ জুন থেকে শুরু হবে সংসদের অধিবেশন। তার আগেই তাঁকে ঠিক করতে হবে দলের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তকে মান্যতা দিয়ে ওই পদ তিনি গ্রহণ করবেন কি না।
রায়বেরিলি না ওয়েনাড, রাহুল কোনটা রাখবেন, কোনটা ছাড়বেন সেই সিদ্ধান্ত অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করছে। সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ছেড়ে দেওয়া কেন্দ্রে প্রিয়াঙ্কা দাঁড়াবেন কি না। এ নিয়ে কংগ্রেসে তো বটেই, গান্ধী পরিবারও রয়েছে এক প্রবল দোলাচলের মধ্যে। অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির (এআইসিসি) এক নেতা বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে এ প্রসঙ্গে বলেন, সিদ্ধান্তটা কঠিন। তবে বেশি দিন ঝুলিয়ে না রেখে দল তা দ্রুত গ্রহণের পক্ষাপাতী এবং সেই সিদ্ধান্ত অবশ্যই হতে হবে পুরোপুরি রাজনৈতিক।
ওই নেতার কথায়, দোলাচল সবচেয়ে বেশি গান্ধী পরিবারে। বিশেষ করে সোনিয়া গান্ধীর। প্রিয়াঙ্কা দুই কেন্দ্রের যেখান থেকেই দাঁড়ান, তিনি জিতবেন। ফলে গান্ধী পরিবারের তিন সদস্যই সংসদের সদস্য হবেন। সেটা হতে পারে বিজেপির পরিবারবাদ বিরোধিতার আরও একটা অস্ত্র। রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা একই কক্ষের সদস্য হওয়ার ফলে বিভিন্ন বিষয়ে ভাই ও বোনের মধ্যে তুলনাও টানা হবে। সোনিয়া মনে করছেন তাতে জটিলতা বাড়তে পারে। কংগ্রেসের ওই নেতার মনে হয়েছে, প্রিয়াঙ্কার সাংসদ হওয়ার বিষয়ে সোনিয়া হয়তো ব্যক্তিগতভাবে খুব একটা আগ্রহী নন; কিন্তু রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তাও তিনি আবার অস্বীকার করতে পারছেন না। বিশেষ করে প্রিয়াঙ্কা যখন পুরোপুরি রাজনীতিতে নেমেই পড়েছেন এবং যথেষ্টই আগ্রহী।
সম্প্রতি রায়বেরিলি ও ওয়েনাডের জনতাকে ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে রাহুল এ বিষয়ে কিছু স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন। কংগ্রেসের দৃঢ় ধারণা, রাহুল রায়বেরিলিই রাখবেন। সেটাই হবে উপযুক্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কেন তা ব্যাখ্যা করে ওই নেতা বলেন, উত্তর প্রদেশে কংগ্রেস শক্তিশালী না হলে দেশের ক্ষমতা লাভ করা কঠিন। অনেক দিন পর উত্তর প্রদেশে কংগ্রেস পায়ের তলায় কিছুটা জমি খুঁজে পেয়েছে। কংগ্রেসীদের মনোবলও ফিরে আসছে। অনেক বছর পর সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব ও রাহুলের রাজনৈতিক সম্পর্ক ও সমীকরণ ভালো হয়েছে। দুজনেই বুঝেছেন, বিজেপির মোকাবিলা করতে গেলে একে অপরকে প্রয়োজন। উত্তর প্রদেশে কংগ্রেসকে মজবুত হতে গেলে রাহুলের উচিত রায়বেরিলি ধরে রাখা। তাতে ইতিবাচক বার্তা যাবে।
কিন্তু একই সঙ্গে দরকার দাক্ষিণাত্যকেও। দলের অধিকাংশের ধারণা, ওয়েনাড ছেড়ে দিলে কেরালার কংগ্রেসিদের মনে একটা হতাশা জন্ম নিতে পারে। ২০২৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে তার প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে ওই রাজ্যে বিজেপি ইতিমধ্যেই যখন কিছুটা প্রভাব বিস্তার করেছে। দলের অধিকাংশ তাই মনে করছেন, রাহুল ওয়েনাড ছাড়লেও প্রিয়াঙ্কা যদি উপ নির্বাচনে দাঁড়ান, তা হলে দলের কোনো ক্ষতি হবে না; বরং প্রিয়াঙ্কার উপস্থিতি রাজ্য রাজনীতিতে এক অন্য মাত্রা জুড়ে দেবে।
এই দোলাচলকে রাহুল নিজে বলেছেন এক অদ্ভুত ‘ধর্মসংকট’। তবে ওয়েনাডে গিয়ে তিনি যখন বলেছেন, যে সিদ্ধান্তই নিন তা রায়বেরিলি ও ওয়েনাড দুই কেন্দ্রের জনতাকেই খুশি করবে, তখন মনে করা হচ্ছে প্রিয়াঙ্কাই হবেন উপনির্বাচনের একমাত্র উত্তর।
এ রকমই দোলাচলে রাহুল রয়েছেন লোকসভার বিরোধী নেতার দায়িত্ব নেওয়ার প্রশ্নে। কংগ্রেস সংসদীয় দল সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাব নিয়েছে রাহুলকে নেতা করার বিষয়ে। কিন্তু এখনো তিনি হ্যাঁ বা না কিছুই বলেননি। ২০১৯ সালেও কংগ্রেস চেয়েছিল রাহুল বিরোধী নেতা হোন। কিন্তু সেবার কংগ্রেস তা দাবি করতে পারেনি ন্যূনতম ৫৫ আসন না পাওয়ায়। অধীর চৌধুরী বিরোধী নেতা হয়েছিলেন, বিজেপি আপত্তি জানায়নি বলে। সেবার রাহুল বিজেপির কৃপায় নেতার পদ গ্রহণে অসম্মত হয়েছিলেন। তা ছাড়া ওই গুরুদায়িত্ব পালনের জন্য তিনি প্রস্তুত কি না, সেই দ্বন্দ্বও তখন তাঁর মধ্যে ছিল। এবার কংগ্রেসকে শাসক দলের দয়ার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে না। সংসদে বিজেপিকে টেক্কা দিতে রাহুলকেই সবাই চাইছেন। কী করবেন তিনি? সামনে থেকে বিরোধীদের নেতৃত্ব দেবেন, নাকি অন্য কাউকে সে জন্য বেছে নেবেন? নেতৃত্ব না দিলে বিজেপি প্রচারের অন্য একটা হাতিয়ার পেয়ে যাবে। রাহুলের যোগ্যতা ও ‘সিরিয়াসনেস’ নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেবে। অধিকাংশ কংগ্রেস নেতা মনে করেন বিজেপিকে সেই সুযোগ দেওয়া উচিত হবে না , বিশেষ করে ভারত জোড়ো যাত্রা এবং নির্বাচনের পর রাহুলের ভাবমূর্তি যখন বদলে গেছে।
ইন্ডিয়া জোটের ভবিষ্যৎ কী হবে সেই সিদ্ধান্তও কংগ্রেসকে নিতে হবে। লোকসভা ভোট বিরোধী জোটকে যে প্রেরণা জুগিয়েছে, তা বজায় রাখতে গেলে কংগ্রেসকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। বিশেষ করে রাহুলকে। এ বছরেই মহারাষ্ট্র, হরিয়াণা ও ঝাড়খন্ড বিধানসভার নির্বাচন। জোটবদ্ধ থাকতে পারলে তিন রাজ্যেই ‘ইন্ডিয়া’র ক্ষমতা আসার সম্ভাবনা। সামনের বছর গোড়ায় ভোট দিল্লি বিধানসভার। আম আদমি পার্টির (আপ) সঙ্গে কংগ্রেস জোটবদ্ধ থাকবে কি না, ঠিক করতে হবে তা–ও। আপ নেতাদের কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন, ওই জোট ছিল লোকসভার জন্য। বিধানসভায় তারা পৃথক লড়বে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গেও জোট নিয়ে প্রবল আড়ষ্ঠতা রয়েছে দুই দলে। ‘ইন্ডিয়া’ ঐকবদ্ধ থাকা না থাকার ক্ষেত্রে তারও সমাধান প্রয়োজন।
এই বছর জম্মু–কাশ্মীরেও ভোট। উপত্যকার প্রধান দুই দল ন্যাশনাল কনফারেন্স ও পিডিপি গুপকর জোটের শরিক হলেও লোকসভা ভোটে জোটবদ্ধ থাকতে পারেনি। তাতে দুই দলেরই ক্ষতি হয়েছে। মেহবুবা মুফতি ও ওমর আবদুল্লাহ দুজনেই হেরেছেন। বিধানসভা ভোটে দুই দলের মধ্যে বোঝাপড়া করানোর চেষ্টাও রাহুলকে করতে হবে। না হলে বিজেপি ও তার সহযোগী দলগুলোকে ঠেকিয়ে রাখা কঠিন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য মহারাষ্ট্র। লোকসভা নির্বাচনের ফল বোঝাচ্ছে, উদ্ধব ঠাকরে, শারদ পাওয়ার ও কংগ্রেস একজোট থাকলে বিজেপি ও তার দুই শরিকের হাত থেকে মহারাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করা মোটেও কঠিন নয়। লোকসভা ভোটে আসন বন্টন নিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে উদ্ধব ঠাকরের কিছুটা টানাপড়েন চলেছিল। সেই টানাপড়েন আরও বড়ভাবে বিধানসভার ভোটে দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রাজ্যে শিবসেনা বড় শক্তি হলেও লোকসভা ভোটে দেখা গেল কংগ্রেস তাদের টপকে গেছে। এ অবস্থায় বিধানসভা ভোটের আগে শিবসেনা–কংগ্রেস সমীকরণ ঠিক রাখতে হলে রাহুলকে বাড়তি উদ্যোগ নিতে হবে। কংগ্রেসের মুশকিল হলো মহারাষ্ট্রে তাদের কোনো মুখ নেই। রাজ্য রাজনীতির প্রধান মুখ উদ্ধব ঠাকরে। সেই সত্য মেনে নিয়েই কংগ্রেসকে নীতি ঠিক করতে হবে। রাহুলকেও সব সিদ্ধান্ত নিতে হবে ভেবেচিন্তে।