বিষয়টি তুলনীয় হতে পারে ‘ভুতের মুখে রাম নাম’ এই প্রবাদের সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর যে নাম গত দশ বছরে নরেন্দ্র মোদি প্রকাশ্যে একবারের জন্যও উচ্চারণ করেননি, যাঁদের মদদ দেওয়ার ‘অপরাধে’ তাঁকে শুনতে হয়েছে এটা ‘সুট বুট কি সরকার’—এমন আরও অনেক সমালোচনা, সেই দুই শিল্পপতি আম্বানি ও আদানিকে টেনে মোদি আক্রমণ করলেন কংগ্রেসের ‘শাহজাদা’ রাহুল গান্ধীকে! কেন করলেন? কী উদ্দেশ্যে?
গত ২৪ ঘন্টা ধরে সেই উত্তর খুঁজে চলেছে ভারতীয় রাজনৈতিক মহল ও গণমাধ্যম। বিস্ময়ের এটাই যে, এখনো কারও কাছে এই মন্তব্যের নির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই! অথচ জনপ্রিয় ধারণা, নরেন্দ্র মোদি কার্যকারণ ছাড়া একটি শব্দও বাড়তি খরচ করেন না।
তেলেঙ্গানায় নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে গতকাল বুধবার বলা নেই, কওয়া নেই—মোদি হঠাৎই আম্বানি–আদানির উল্লেখ করে রাহুল গান্ধীকে বিদ্ধ করেন। তিনি বলেন, গত পাঁচ বছর যাবত নিয়ম করে যাঁর মুখে আম্বানি–আদানির নাম শোনা যেত, নির্বাচনী প্রচার শুরু হওয়া মাত্র তিনি কেন হঠাৎ চুপ করে গেলেন? বন্ধ করে দিলেন গালি দেওয়া? জানতে চাই, কংগ্রেসের শাহজাদা কত ‘মাল’ পেয়েছেন? থলে বোঝাই কত কালো টাকা মেরেছেন? টেম্পো (ছোট ট্রাক) বোঝাই কত কালো টাকা কংগ্রেসের কাছে পৌঁছেছে? কী সওদা হয়েছে যে রাতারাতি গালি দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে?
ওখানেই থামেননি মোদি। বলেন, ‘ডাল মে জরুর কুছ কালা হ্যায়।’ পাঁচ বছর ধরে আম্বানি–আদানিকে গালি দেওয়ার পর রাতারাতি চুপ করে যাওয়ার অর্থ টেম্পো বোঝাই চুরির মাল পাওয়া। দেশকে এর জবাব দিতে হবে।
এবারের ভোটের প্রচারে নিঃসন্দেহে এই মোদি উবাচই সবচেয়ে বিস্ময়কর! রাজনৈতিক মহল সঙ্গে সঙ্গেই চনমনে হয়ে ওঠে। গণমাধ্যম খুঁজতে শুরু করে, রাহুল, প্রিয়াঙ্কা বা কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গেসহ কোনো নেতা আম্বানি–আদানি প্রসঙ্গে মোদি সরকারকে তুলোধোনা করেছেন কি না। সত্যিই রাহুল ওই দুই শিল্পপতি নিয়ে মৌন কি না।
নির্বাচনী প্রচারের সময়কাল খুঁজতে গিয়েই দেখা গেল, চিত্রটা মোদির অভিযোগের ঠিক বিপরীত। নিয়ম করে রাহুল ও অন্যরা আদানি–আম্বানির নামোচ্চারণ করেছেন। মোদি সরকার যে স্রেফ তাঁদের মতো ২২–২৫ জন শিল্পপতির স্বার্থে কাজ করে চলেছে, সেই অভিযোগ তুলেছেন একের পর এক জনসভায়। শুধু তাই নয়, সরকারবান্ধব শিল্পপতিদের জন্য মোদি সরকার যে পরিমাণ ঋণ ছাড় দিয়েছে, সমপরিমান টাকা কংগ্রেস গরিবদের দেবে বলেও রাহুল জানিয়েছেন।
এই সত্য জানাজানি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে যায় সেই অমোঘ প্রশ্ন, তা হলে প্রধানমন্ত্রী কেন এই প্রসঙ্গ টেনে আনলেন? কোন উদ্দেশ্যে? বলা ভালো, সেই উত্তর এখনো কারও কাছে নেই। যদিও সবাই বেশ বুঝতে পারছেন, বিনা উদ্দেশ্যে এমন গুরুতর অভিযোগ তোলার মানুষ আর যেই হোন, নরেন্দ্র মোদি নন।
কেন গুরুতর, রাহুল গান্ধী নিজেই তা বুঝিয়ে দেন সামান্য সময়ের মধ্যে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি এক ভিডিও বার্তা পাঠান। পেছনে মহাত্মা গান্ধীর ছবি রেখে সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে সেই বার্তায় রাহুল বলেন, ‘নমস্কার মোদিজি, আপনি কি একটু নার্ভাস? সাধারণত আপনি বন্ধ কামরার মধ্যে আদানি–আম্বানির নাম নেন। এই প্রথম প্রকাশ্যে ওঁদের নাম নিলেন। শুধু তাই নয়, আপনি এও জানেন, ওঁরা টেম্পো বোঝাই করে নগদ টাকা দেন। এটা কি আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা? আপনি এক কাজ করুন। ওদের কাছে সিবিআই, ইডি পাঠান। ওদের দ্রুত তদন্তের আওতায় আনুন।’
এর পরেই রাহুল বলেন, ‘চিন্তা করবেন না, আমি দেশকে আবার আশ্বস্ত করছি, যে টাকা নরেন্দ্র মোদি ওদের দিয়েছেন, আমরা সেই পরিমাণ টাকা দেশের গরিবদের দেব। মহালক্ষ্মী যোজনা, পহেলা নৌকরি পাক্কি যোজনার মাধ্যমে। আপনার সরকার ২২ জন কোটিপতি তৈরি করেছে, আমরা কোটি কোটি লাখপতি তৈরি করব।’
মোদির মন্তব্যের পর কংগ্রেস তাঁকে ও বিজেপিকে আক্রমণে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট করেনি। খাড়গে বলেন, ‘তিন দফা ভোটের পর সময় বদলাচ্ছে। বন্ধু আর বন্ধু থাকছে না। প্রধানমন্ত্রী নিজেই তাঁর বন্ধুদের আক্রমণ করছেন। বেশ বোঝা যাচ্ছে, তাঁর কুর্সি টলমল করে উঠেছে। এটাই নির্বাচনী ফলাফলের পূর্বাভাস।’
এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাঁর অনেক দাবির অসাড়ত্বও কিন্তু প্রমাণ করে দিলেন। যেমন, কালো টাকা। ২০১৬ সালে ‘নোট বাতিল’ করার মূল কারণ ছিল কালো টাকার জোগান বন্ধ করা। বারবার মোদি নিজে সেই দাবি করেছিলেন। অথচ নিজেই ‘কালো টাকার’ কথা বলে বুঝিয়ে দিলেন, নোট বাতিল প্রকল্প কালো টাকার জোগান বন্ধ করতে পারেনি।
মোদি তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে এও বুঝিয়ে দিলেন, আম্বানি–আদানিরা রাজনৈতিক দলকে কালো টাকা দেন। সেই তথ্য জানা আছে বলেই মোদি অত নিশ্চিতভাবে সেটি উল্লেখ করেছেন।
এখন বিরোধীরা প্রশ্ন করছেন, আদানি–আম্বানি কালো টাকার কারবার করেন জানা সত্ত্বেও মোদি কেন ইডি, সিবিআইকে তাঁদের ঘরে পাঠাননি? বস্তুত, বিজেপির কোনো নেতাই এই সব প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি।
পরিস্থিতি লুফে নিতে কংগ্রেস দেরি করেনি। দলের পক্ষ থেকে স্থান, কাল, তারিখ দিয়ে দেখানো হয়েছে, নির্বাচনী প্রচারে রাহুল গান্ধী কোথায় কতবার আদানি–আম্বানির নামোচ্চারণ করেছেন। দেখানো হয়েছে, গত ৩ এপ্রিল থেকে ৭ মে পর্যন্ত রাহুল নির্বাচনী জনসভায় ১০৩ বার আদানি ও ৩০ বার আম্বানির নাম করেছেন। মোদি সরকারের সঙ্গে ওই দুই শিল্পপতির আঁতাতের প্রসঙ্গ তুলে গুরুতর অভিযোগও করেছেন। রাহুলের সেই সব ভাষণের ভিডিও একত্রিত করে কংগ্রেস গণমাধ্যমে দিয়েছে।
মোদি যেদিন ওই মন্তব্য করেন, সেদিনই রায়বেরিলিতে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বলেন, রাহুল গান্ধী রোজ আদানি–আম্বানির নাম করছেন। মোদি সরকার তাঁর শিল্পবন্ধুদের ১৬ লাখ কোটি টাকার ঋণ মকুফ করেছেন। অথচ কৃষকদের ঋণ মকুফ করেননি। যে পরিমাণ টাকা মোদি সরকার তাঁর শিল্পবন্ধুদের ছাড় দিয়েছেন, সেই পরিমান টাকা কংগ্রেস গরিবদের দেবে।
রাহুল গান্ধীর মনে হয়েছে নরেন্দ্র মোদি নার্ভাস। তিন দফার ভোটের হার বুঝিয়েছে বিজেপি ও এনডিএ তাদের লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছতে পারেনি। রাহুলের মতো অনেক বিরোধী নেতার ধারণাও তাই। প্রথম দফার ভোটের পর তাই মোদি মুসলমান–জুজু টেনে এনেছেন। সম্পদ বিলির প্রসঙ্গ তুলেছেন। হিন্দু মা–বোনদের গলার মঙ্গলসূত্র কেড়ে নেওয়ার কথা বলেছেন। ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণ দেওয়ার কংগ্রেসি অভিপ্রায়ের প্রসঙ্গ তুলেছেন।
সর্বশেষ আদানি–আম্বানিকে টেনে কংগ্রেসকে ‘কালো টাকা’ দেওয়ার কথা বলে তিনি সম্ভবত এটাই বোঝাতে চেয়েছেন, চাঁদাবাজি শুধু বিজেপিই নয়, কংগ্রেসও করে। হতে পারে ওই কথা বলে তিনি শিল্পবান্ধব ভাবমূর্তি ঘোচানোর চেষ্টা করেছেন।
২৪ ঘন্টা কেটে গেছে। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী নতুন করে আর ওই প্রসঙ্গের অবতারণা করেননি। ২৪ ঘন্টা পরেও নিশ্চিতভাবে কেউ জানে না, নরেন্দ্র মোদির ওই অস্বাভাবিক মন্তব্য করার কারণ কী। রহস্য উদ্ঘাটনে সত্যান্বেষীর প্রয়োজন।