কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর মণিপুর সফর এবং গত প্রায় দুই মাসব্যাপী সংঘর্ষে বিধ্বস্ত পরিবারের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের পাশাপাশি নানা ঘটনায় আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে হিংসা-বিধ্বস্ত রাজ্যের রাজনীতি। রাহুল গান্ধী মণিপুরে ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে দেখা করার পাশাপাশি রাজ্যের রাজ্যপাল অনুসুইয়া উইকের সঙ্গেও দেখা করেন। রাজ্যে শান্তি ফেরানোর জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপের ওপর জোর দেন রাহুল।
এদিকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং শুক্রবার রাজ্যপালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি রাজ্যপালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার আগে মনে করা হয় যে তিনি পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন। এরপরই পথে নেমে তাঁকে আটকানোর চেষ্টা করেন কয়েক হাজার মেইতেই মণিপুরি, যাঁদের মধ্যে উগ্র-জাতিবাদী সংগঠন আরামবাই টেঙ্গোলের সদস্যরাও ছিলেন। কালো টি-শার্ট পরা আরামবাই টেঙ্গোলের সদস্যরা তাঁকে পদত্যাগপত্র ফিরিয়ে নিতে বলেন। মেইতেই সমাজের নারীরাও তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করেন এবং মুখ্যমন্ত্রীকে বাসভবন থেকে বেরোতে বাধা দেন।
নারীদের একজনকে প্রচারমাধ্যমে বলতে শোনা যায়, ‘এখন বীরেন সিং পদত্যাগ করলে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হবে, যা মণিপুরের বর্তমান পরিস্থিতিতে কাম্য নয়।’ বীরেন সিং অবশেষে সমাজমাধ্যম টুইটারে লেখেন, ‘এ রকম জটিল পরিস্থিতিতে আমি মুখ্যমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করছি না।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর ছিঁড়ে ফেলা পদত্যাগপত্রটিও কিছু পরে দেখতে পাওয়া যায়।
এদিকে দুই সপ্তাহ শান্ত থাকার পর ইম্ফলের উত্তরে কাংপোকপি জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় বন্দুকযুদ্ধে অন্তত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এঁদের মধ্যে পুলিশের এক হেড কনস্টেবলও রয়েছেন। তাঁর নাম লেংলাম ডিনজেল।
রাহুল গান্ধীর সফর
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী শুক্রবার মণিপুরে ক্ষতিগ্রস্ত এবং বাস্তুচ্যুত মানুষের সঙ্গে দেখা করতে মণিপুরের মইরাংয়ে পৌঁছান। রাহুল সকাল সাড়ে নয়টা নাগাদ ইম্ফল থেকে একটি হেলিকপ্টারে সেখানে যান এবং দুটি ত্রাণশিবিরে বেশ কিছু উদ্বাস্তুর সঙ্গে দেখা করেন, তাঁদের দুর্দশার কথা শোনেন। কংগ্রেস দলের কাছে মইরাংয়ের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে; কারণ, এই শহর থেকেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (আইএনএ) ১৯৪৪ সালে ভারতের পতাকা দেশের মাটিতে উত্তোলন করেছিল। যদিও সে সময় সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সম্পর্ক ভালো ছিল না।
শুক্রবার রাহুল গান্ধীর সঙ্গে ছিলেন কংগ্রেসের নেতারা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মণিপুরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওকরাম ইবোবি সিং, দলের সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) কে সি ভেনুগোপাল, মণিপুর কংগ্রেস সভাপতি কেশাম মেঘচন্দ্র সিং এবং সাবেক সংসদ সদস্য অজয় কুমার। এরপর সমাজমাধ্যম একটি ইনস্টাগ্রাম বার্তায় রাহুল বলেন, ‘মণিপুরে সহিংসতার কারণে যাঁরা প্রিয়জন এবং ঘরবাড়ি হারিয়েছেন, তাঁদের দুর্দশা দেখলাম, কথা শুনলাম। হৃদয়বিদারক। আমার দেখা প্রতিটি ভাই, বোন এবং শিশুর মুখে সাহায্যের জন্য আর্তনাদ রয়েছে।’
রাহুল গান্ধী বলেন, মণিপুরে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শান্তি স্থাপন। জনগণের জীবন-জীবিকা সুরক্ষিত করতে হবে আমাদের। আমাদের সব প্রচেষ্টাকে সেই লক্ষ্যে একত্র করতে হবে। রাজভবনে রাজ্যপালের সঙ্গে সাক্ষাতের পরও তিনি একই কথা বলেন। রাহুল বলেন, ‘শান্তির জন্য যা যা প্রয়োজন, আমি তার জন্য প্রস্তুত। আমি শান্তি বজায় রাখার জন্য সবার আবেদন করছি। সহিংসতা কোনো পথ হতে পারে না।’
রাহুল গান্ধী মণিপুরের নাগরিক সমাজের সদস্যদের সঙ্গেও দেখা করেন এবং তাঁদের সমস্যার কথা শোনেন। যেসব সংগঠনের সঙ্গে তিনি দেখা করেন, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ইউনাইটেড নাগা কাউন্সিল। এই সংগঠন মণিপুরের নাগা সমাজের মধ্যে প্রভাবশালী। এ ছাড়া মণিপুরের প্রভাবশালী সংগঠনের মধ্যে রয়েছে প্রধানত মেইতেই-নেতৃত্বাধীন সংগঠন কো-অর্ডিনেটিং কমিটি অন মণিপুর ইন্টেগ্রিটি, তফসিলি উপজাতিদের একটি সংগঠনসহ জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের সঙ্গে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানী ইম্ফলের দক্ষিণে বিষ্ণুপুর এলাকায় পুলিশ রাহুল গান্ধীর গাড়িবহরকে থামানোর পর একটি হেলিকপ্টার নিয়ে তিনি চুড়াচাঁদপুরে ত্রাণশিবির পরিদর্শন করেন। বিজেপি নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারকে আক্রমণ করে বলেন যে তিনি মণিপুরের ভাই-বোনদের কথা শুনতে এসেছিলেন, কিন্তু তা করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে।
গতকাল টুইটারে রাহুল লিখেছিলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক যে সরকার আমাকে বাধা দিচ্ছে। মণিপুরের নিরাময় প্রয়োজন। শান্তি আমাদের একমাত্র অগ্রাধিকার হতে হবে।’
গত ২৪ ঘণ্টায় তিন ব্যক্তির মৃত্যুর পাশাপাশি রাজ্যের বিভিন্ন অংশ থেকে ১৭টি অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং ১০টি বোমা উদ্ধার করা হয়েছে। বুধবার নিরাপত্তা বাহিনীর যৌথ দল কাকচিং জেলা থেকে আটটি অস্ত্র, গোলাবারুদ ও দুটি বোমা উদ্ধার করেছে বলে মণিপুর পুলিশ জানিয়েছে।