ভারতীয় রাজনীতির নাটকীয় মোড় বদল

দুই মেয়াদে ক্ষমতায় আছে বিজেপি। গত দুটি নির্বাচনী যুদ্ধে তাদের প্রধান অস্ত্র ছিল হিন্দুত্ববাদ। এই একই অস্ত্রে আসন্ন ভোটেও ভারতের পুরোনো বহুত্ববাদী রাজনীতিকে বধ করা যাবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ দেখা দিচ্ছে।

মেইতেই সম্প্রদায়ের সঙ্গে জাতিগত সংঘাতে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কুকিদের ঘরবাড়ি। গোলতাবির নিজ বাড়িতে ফিরতে ও সেখান থেকে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভ করছেন একদল বাস্তুচ্যুত মানুষ। ভারতের মণিপুর রাজ্যের ইম্ফল ইস্টে গত ১৬ আগস্ট

স্থান-কাল-উপলক্ষভেদে সব হাতিয়ারের ধার পাল্টায়। প্রতিটি যুদ্ধে তাই নতুন অস্ত্র খোঁজেন বুদ্ধিদীপ্ত যোদ্ধারা। ভারতে ২০২৪ সালে জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচন কেবল ভারতের জন্য নয়, এমনকি শুধু দক্ষিণ এশিয়ার পরিসরে নয়—বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় পুরো বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

একনাগাড়ে দুই মেয়াদে ক্ষমতায় আছে বিজেপি। গত দুটি নির্বাচনী যুদ্ধে তাদের প্রধান অস্ত্র ছিল হিন্দুত্ববাদ। এই একই অস্ত্রে আসন্ন ভোটেও ভারতের পুরোনো বহুত্ববাদী রাজনীতিকে বধ করা যাবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করছেন কেউ কেউ।

বিশেষ করে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এবং তাঁর মিত্র-জোট এমন এক নতুন হাতিয়ারসহ রাজনীতি সাজাতে শুরু করেছেন, তাতে আরএসএস-বিজেপি পরিবারের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ ঘটেছে।

 ‘ইন্ডিয়া’ বনাম ভারত

এ বছরের জুলাইয়ে ভারতে ২৪টি বিরোধী দলের একটা জোট গড়ে উঠেছে ‘আইএনডিআইএ’ বা ইন্ডিয়া নামে। ইংরেজিতে নিজেদের তারা বলছে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স’। প্রায় এক দশক ক্ষমতায় থাকার মধ্য দিয়ে বিজেপি এখন এতটাই শক্তিশালী এবং বিরোধী দলগুলো পরিবর্তনের জন্য এতটা মরিয়া যে বিচিত্র চরিত্রের দুই ডজন দলের একত্র হওয়া তারই সাক্ষ্য দেয়।

তবে বিরোধী দলগুলোর ‘ইন্ডিয়া’ নামে জোট গঠনের পর থেকে আরএসএস-বিজেপি পরিবার ‘ভারত’ কথাটা বেশি করে ব্যবহার শুরু করেছে। সম্প্রতি কূটনীতির আসরগুলোতে ‘প্রাইম মিনিস্টার অব ভারত’, ‘প্রেসিডেন্ট অব ভারত’ ইত্যাদি শব্দ শোনা যাচ্ছে। অথচ এত দিন শোনা যেত ‘প্রাইম মিনিস্টার অব ইন্ডিয়া’, ‘প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া’ ইত্যাদি।

আন্তর্জাতিক সব স্তরে ‘ইন্ডিয়া’ নাম চালু থাকার পরও দেশটির শাসক দল হঠাৎ যে ‘ভারত’ শব্দের ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছে, তার কারণ হিসেবে অনুমান করা হয় বিরোধী জোটের ‘ইন্ডিয়া’ নাম নেওয়া। গত দুই মাস ভারতজুড়ে নাম নিয়ে কাজিয়া বাড়ার মধ্যেই কংগ্রেস ও ‘ইন্ডিয়া’ জোট নতুন একটা দাবি তুলছে। তারা বলছে, দেশে ‘কাস্ট সেনসাস’ বা ‘বর্ণশুমারি’ করতে হবে। দাবিটি আপাতদৃষ্টে নিরীহ। কিন্তু এর ভেতর ভূমিকম্পতুল্য রাজনৈতিক ফলাফলের বীজ আছে। ভারতে ইতিমধ্যে তার কম্পন শুরুও হয়ে গেছে।

আলোচনায় স্পর্শকাতর বর্ণপ্রশ্ন

২০২১ সালের সর্বশেষ শুমারি মহামারিতে আটকে গেলেও স্বাধীন ভারতে এ পর্যন্ত সাতবার শুমারি হয়েছে। এর মধ্যে একবারও বর্ণশুমারি হয়নি। সর্বশেষ শুমারির (২০১১) জাতপাত সম্পর্কিত তথ্যও প্রকাশ করা হয়নি।

ভারত বিশ্বে যেসব কারণে আলোচিত হয়, তার একটি দেশটির বর্ণব্যবস্থা। কিন্তু এখানকার বর্ণবিন্যাসের তথ্য-উপাত্ত মোটাদাগে ঔপনিবেশিক শাসনামলের। ১৯৩১ সালে দেশটিতে সর্বশেষ বর্ণশুমারি হয়। ২০০১ সালের শুমারিতে ‘বর্ণ’ বিষয়ে একটা অনুচ্ছেদ যুক্ত করার কথা ছিল। কিন্তু এসব তথ্য প্রকাশিত হলে তার সামাজিক ও প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়ার ভয়ে সেটা এগোয়নি। এসব বিবেচনায় বর্ণশুমারিকে বহুদিন থেকে বলা হচ্ছে এমন এক ভারতীয় ‘প্যানডোরার বাক্স’, যা রাজনীতির চেনা ছক বদলে দিতে পারে।

ভারতভূমি থেকে দূরে থাকা মানুষের কাছে প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন বর্ণশুমারি স্পর্শকাতর বিষয়? অনুমান করা হয়, সঠিক পেশাদারত্বের সঙ্গে বর্ণশুমারি হলে মাঠপর্যায় থেকে ভারতীয় সমাজের যে প্রকৃত চিত্র আসবে, তাতে প্রশাসনের এত দিনকার উন্নয়ন অগ্রাধিকার আমূল পাল্টাতে হবে। স্বাধীনতার পর গত সাত-আট দশক রাষ্ট্রীয় সম্পদে উচ্চবর্ণের যে আধিপত্য চলছে, বর্ণশুমারি তা বদলে ফেলার জোরালো রাজনৈতিক তাগিদ তৈরি করতে পারে। নিশ্চিতভাবে এত দিনকার সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী এ রকম পরিস্থিতি ঠেকাতে কিছু না কিছু করতে চাইবে।

হিন্দুত্ববাদের জন্য বর্ণশুমারি কেন বিপজ্জনক

অনেকেই বলছেন, কাস্ট শুমারি ‘ইন্ডিয়া’ জোটের জন্য একটা ব্রহ্মাস্ত্রের মতো কাজ করতে পারে, যদি প্রকৃতই তারা এই দাবিতে আন্তরিক হয়। আমরা জানি, সনাতন পুরাণের ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ অতিপ্রাকৃত এবং দৈব কোনো অস্ত্রের ইঙ্গিত দেয়। সেই অস্ত্র যেভাবে চরম ক্ষমতাধর অশুভকে তাড়াতে কার্যকর, তেমনি সমকালীন সমাজের ‘রাক্ষস’রূপী সামাজিক বৈষম্য তাড়াতেও বর্ণশুমারি একটা সূচনাবিন্দু হতে পারে।

এ রকম শুমারি হলে নীচুতলার মানুষের মধ্যে তাদের বঞ্চনাবোধের সামাজিক চিত্র প্রকাশিত হয়ে যেতে পারে। কীভাবে বর্ণব্যবস্থার ওপরের স্তরে থাকা ছোট একটা গোষ্ঠী হিন্দুত্ববাদের আড়ালে সমাজে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভুত্ব করে যাচ্ছে এবং সেই প্রভুত্বকে ন্যায্যতা দিতে নিজস্ব বাছাইকৃত কিছু ধর্মীয় বয়ান হাজির করছে, তা উন্মোচন করে দিতে পারে বর্ণশুমারি। ইতিমধ্যে তার আঁচ পাওয়া যাচ্ছে বিহারে এবং অন্যত্রও।

আম্বেদকর ও যোগেন্দ্রনাথ যা বদলাতে চেয়েছিলেন

ভারতীয় বর্ণব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিত অনেকেই জানেন, সেখানে পেশা ও জন্মগত মানদণ্ডে হিন্দুদের চার স্তরে ভাগ করা হয়েছে: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। এই চার স্তরের বাইরেও অনেককে রাখা হয়েছে ‘অবর্ণ’ হিসেবে।

এই বর্ণ ও অবর্ণ উভয় ব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশটিতে অপেক্ষাকৃত নীচুতলার মানুষের জন্য অনেকগুলো সামাজিক-প্রশাসনিক শব্দ তৈরি হয়েছে। যেমন এসসি (শিডিউল কাস্ট), এসটি (শিডিউল ট্রাইব), ওবিসি (আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস), ইবিসি (এক্সট্রিমলি ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস) ইত্যাদি। প্রশাসনিক এসব বর্গীকরণ বিশেষভাবে শুরু হয় ১৯৩৫ থেকে। দেশ স্বাধীনের পর সেটা ধাপে ধাপে আরও এগিয়েছে।

ওপরে যেসব সামাজিক বর্গের কথা বলা হলো, তারা কমবেশি নানা ধরনের বঞ্চিত জনগোষ্ঠী। যেমন এসসিরা মূলত সামাজিকভাবে বঞ্চিত জনগোষ্ঠী। আর এসটির বঞ্চনা ভৌগোলিক কারণেও। ভারতজুড়ে কেবল এসটি (শিডিউল ট্রাইব) আছে কয়েক শ। ওপরের সব শিরোনামের সামাজিক বর্গগুলো কেউ কেউ আবার ঐতিহাসিকভাবে অস্পৃশ্যতারও শিকার। যাঁরা নিজেদের ‘দলিত’ও বলেন।

সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া বা পিছিয়ে রাখা এসব জনগোষ্ঠীকে প্রশাসনিক পৃথক নামকরণের ঘোষিত প্রকাশ্য লক্ষ্য ছিল কিছু কিছু সুবিধা দিয়ে তাদের অবস্থার পরিবর্তন আনা। ‘সুবিধা’ বলতে ভর্তি, চাকরি, নির্বাচনী আসন বরাদ্দে কিছু কিছু কোটা বেঁধে দেওয়া।

অনেক সমালোচকের মতে, প্রশাসনিক এ রকম বর্গীকরণ এবং বিভিন্ন বর্গের জন্য বিভিন্ন সুবিধা বেঁধে দেওয়ার অদৃশ্য একটা ফল দাঁড়ায় ‘নীচু বর্ণ’গুলোকে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে দেওয়া। এতে উঁচু বর্ণ যে সুযোগ-সুবিধার বড় অংশ ভোগ করছে, সেটা আড়ালে থেকে যায়। এ রকম কোটার মাধ্যমে নীতিনির্ধারকদের একটা মানবিক ভাবমূর্তিও তৈরি হয়।

উল্টো দিকে কে কতটুকু কোটা পাচ্ছে, সেসব নিয়ে এসসি-এসটি-ওবিসিরা পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে। যেমন এবার যে মণিপুরে দাঙ্গা হচ্ছে, সেটা মেইতেইরা এসটি সুবিধা চাওয়ায় কুকি-ক্ষোভ থেকে শুরু। অথচ অতীতে মণিপুরে ঐতিহাসিক জাতীয়তাবাদী লড়াইয়ে মেইতেই ও কুকিরা পাশাপাশি ছিল।

বর্ণ-অবর্ণদের কোটা ও সংরক্ষণের এ রকম বিবাদ ব্রিটিশ আমল থেকে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে চলছে। এতে করে বর্ণব্যবস্থা অনেকটা বহালই থেকে গেছে। উঁচু জাতের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আধিপত্যেও কোনো আঘাত লাগেনি। উঁচু জাতের লোকেরা সব সময় ‘নীচু’দের বুঝিয়েছে সমস্যাটা ‘আমরা’ বনাম ‘তোমরা’ নই—সমস্যা, মুসলমান, খ্রিষ্টান ও কমিউনিস্টরা। বোম্বের আম্বেদকর থেকে শুরু করে বরিশালের যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল পর্যন্ত অনেকে এই রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়েছেন—কিন্তু পুরো পেরে ওঠেননি।

ঐতিহাসিক ওই পরম্পরার মধ্যেই সম্প্রতি বিহারের প্রাদেশিক সরকার সেখানে বর্ণশুমারির ডাক দেয়। বিহারে এটা সম্ভব হয়েছে এ কারণে যে এই রাজ্যে অবর্ণ বা দলিতরা সংখ্যায় অনেক এবং তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতার কাজ করা সংগঠনগুলোর শক্তিও বেশ।

কোটা যে বৈষম্য পাল্টাতে পারেনি

বিহারের বর্ণশুমারিতে দেখা যাচ্ছে, সেখানকার প্রায় ৫ ভাগের ৪ ভাগ মানুষ অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী (ওবিসি+এসসি+এসটি= ৮৪%)। নয়াদিল্লি যখন জাতীয় নির্বাচনের আগে আগে চন্দ্র বিজয়ের আনন্দে দেশবাসীকে ভাসাতে চাইছে, তখন বিহারের এই শুমারি ভিন্ন এক জরুরি জায়গায় আলো ফেলছে। বিহারের পর প্রায় একই রকম শুমারির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ওডিশা ও ঝাড়খন্ডে। অনুমান করা হচ্ছে, ওদিক থেকে কাছাকাছি ধরনের তথ্যও মিলবে।

বিহারের শুমারি বিশেষভাবে দেখাচ্ছে হিন্দুত্ববাদের আড়ালে ভারতজুড়ে যে উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার কথা বলা হচ্ছে, তাতে আদানি বা আম্বানিদের মতো বিশ্ব চমকানো মহাধনীদের সংখ্যা বাড়লেও মাঠপর্যায়ে এসসি, এসটি, ওবিসি এবং ইবিসিদের ভাগ্যের চাকা ঘুরছে কম। এ রকম অবস্থা স্বাভাবিকভাবে চলতি রাজনীতির সংস্কারের তাগিদ সামনে নিয়ে আসে।

এসসি থেকে ইবিসি পর্যন্ত পিছিয়ে পড়াদের এত দিন যেসব কোটা ও সংরক্ষণ সুবিধা দেওয়া হয়েছে, সেটা সব মিলে বিদ্যমান সুবিধার ৫০ ভাগের মতো। বাকি ৫০ ভাগ ভোগ করছে ১৫ ভাগ উচ্চবর্ণ। কখনো কখনো চিত্রটা আরও অবিশ্বাস্য রকমে একপেশে। যেমন ২ অক্টোবর রাহুল গান্ধী এক্সে (সাবেক টুইটার) জানালেন, ভারতের কেন্দ্রে যে ৯০ জন সচিব আছেন, তাতে ওবিসি মাত্র ৩ জন।

জাতীয় বাজেটের মাত্র ৫ ভাগ এই তিনজনের হাত দিয়ে খরচ হয়। তথ্য হিসাবে এটা ভয়ানক—কারণ ২০১৪ সালে নির্বাচনকালে বিজেপি ওবিসিবান্ধব দল হিসেবেই নিজেকে তুলে ধরেছিল। ১৯৩১ সালের কাস্ট শুমারিতে দেখা গিয়েছিল ওবিসিরা ভারতীয় সমাজের ৫২ ভাগ। যদি কমবেশি এখনো তাই হয়, তাহলে ৯০ সচিবের মধ্যে তাঁদের ৩ জন থাকা একদম বেমানান।

বিহারের শুমারির পর এ রকম আরও তথ্য-উপাত্ত এখন সুনামির মতো সামনে আসতে শুরু করেছে আর বিরোধী দলগুলো সেসব লুফে নিচ্ছে প্রচারের জন্য।

সাধারণভাবে যা মনে হচ্ছে, হিন্দুত্ববাদের রাজনীতিকে ভারতজুড়ে যখন প্রায় অপরাজেয় ভাবা হচ্ছিল, ঠিক তখন বিহার প্রদেশ রাহুল গান্ধী ও তাঁর মিত্রদের সুবিধাজনক ভিন্ন একটা পথ দেখাচ্ছে।

বিহার কীভারে নতুন পথ দেখাচ্ছে?

গত কয়েক সপ্তাহের ভারতীয় রাজনীতি থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন এবং তার আগের বিভিন্ন প্রাদেশিক নির্বাচনে কংগ্রেস ‘কাস্ট শুমারি’র দাবি সামনে নিয়ে আসবে এবং জাতপাতের বঞ্চনাকে নির্বাচনী ইস্যু করবে। আরএসএসের জন্য এ পরিস্থিতি বিব্রতকর।

কারণ, বিহারে যদি অধিপতি বর্ণ মাত্র ১৫ ভাগ হয়—অন্য রাজ্যেও এদের সংখ্যা কমবেশি এ রকমই হবে। স্বাধীনতার আগে থেকে এরাই সমাজে আধিপত্য করছিল এবং স্বাধীনতার পর এদেরই সম্পদ বেড়েছে। ২০২৩ সালে অক্সফামের প্রতিবেদন (সারভাইভাল অব দ্য রিচেস্ট: ইন্ডিয়া স্টোরি) থেকে দেখা যায়, ভারতের সম্পদের ৪০ ভাগের মালিক দেশটির সর্বোচ্চ স্তরের মাত্র ১ ভাগ মানুষ।

অথচ দেশটিতে ২২–২৩ কোটি দরিদ্র মানুষও আছে। বলা বাহুল্য, এই দরিদ্ররা মূলত এসসি, এসটি ও ওবিসি। রাহুল গান্ধী এবং তাঁদের জোট যদি এখন সমাজের এই ৮৫ ভাগের কণ্ঠস্বর হতে চায়, সেটা একদিকে যেমন কংগ্রেস রাজনীতির জন্য ঐতিহাসিক মোড় বদল, তেমনি একই সঙ্গে হিন্দুত্ববাদের জন্যও চ্যালেঞ্জপূর্ণ।

আদানি-আম্বানি সম্প্রদায়ের সঙ্গে শিডিউল কাস্ট ও শিডিউল ট্রাইবদের অবস্থা অর্থনৈতিক স্বার্থের জায়গা থেকে সাংঘর্ষিক। উভয়ের রাজনীতিও আলাদা হতে বাধ্য। ভোটের প্রচারও সেভাবে হওয়ার কথা। এখন মনে হচ্ছে, রাহুল যে একবার লোকসভার সদস্যপদ হারিয়েও আদানি মডেলের বিরুদ্ধে কথা বলে চলেছেন, তা হয়তো অপরিকল্পিত ব্যাপার নয়। বর্ণশুমারির আলাপ যত জোরদার হচ্ছে, তত অনেকে মনে করছেন ভারতীয় রাজনীতি এত দিন পর কেবল তার মূল প্রসঙ্গ খুঁজে পেল। সেটা যে বিহার থেকে ঘটছে, তা–ও বেশ তাৎপর্যময়।

বিহার অনেক সময়ই ভারতকে পথ দেখিয়েছে। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম সত্যাগ্রহ শুরু করেছিলেন ১৯১৭ সালে বিহারের চম্পারণ থেকে। আবার স্বাধীন ভারতে ইন্দিরা গান্ধী যখন গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরতে গিয়েছিলেন, তখন তা রুখে দাঁড়ান বিহারের জয়প্রকাশ নারায়ণ—ভারতবাসী যাঁকে ‘লোকনায়ক’ বলে স্মরণ করে। রাহুলের সামনে বিহার ইতিহাসের আরেক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হাজির করেছে।

  • আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক