এক দশক ধরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) জোর দিয়ে বলে আসছে, তারা এক ‘নতুন ভারতের’ প্রতিনিধি। এই ভারত স্বজনপ্রীতি (পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি, যেটি বিরোধী দলের ওপর প্রভাব বিস্তার করে আছে) ও দুর্নীতিমুক্ত, যা অতীতের সরকারগুলোকে কলঙ্কিত করেছে।
গতকাল বুধবার বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র এক আলাদা ‘নতুন ভারত’ নিয়ে জেগে উঠেছে। সেখানে মোদির বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে; যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিয়ে এক দশক ধরে দেশ শাসন করে এসেছে তারা। এ অবস্থায় পরবর্তী সরকার গঠনের জন্য জোট শরিকদের ব্যাপারে তোড়জোড় শুরু করতে হচ্ছে দলটিকে।
নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার পর বিজেপি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) ও কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’, উভয় জোটের নেতারা ছুটেছেন নয়াদিল্লিতে। রাজনৈতিক নাটকের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, তা ঠিক করতে নিজেদের মতো করে চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁরা। তবে ১ জুন শেষ হওয়া সাত দফা লোকসভা নির্বাচনের পর কোনো বুথফেরত জরিপেই এমন নাটকের মঞ্চায়ন হওয়া নিয়ে অনুমান করা যায়নি।
‘মোদি সরকার’ এক বিশেষ ধরনের শাসনব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। শরিকদের সঙ্গে সমঝোতা করা বা বিক্রি হয়ে যাওয়া মোদি আমাদের কাছে পরিচিত নন।-নীলাঞ্জন সরকার, সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের (সিপিআর) রাষ্ট্রবিজ্ঞানী
বুথফেরত ও অন্যান্য জরিপে বিজেপি ও এনডিএ জোটের ভূমিধস বিজয়ের আভাস দেওয়া হয়েছিল। অবশ্য শেষ দফার ভোট গ্রহণের পর দেখা গেল, ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় ‘ইন্ডিয়া’জোট পেয়েছে ২৩২টি আসন। অন্যদিকে একক বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হলেও বিজেপি পেয়েছে ২৪০টি (জোটগতভাবে ২৯৩)। বিজেপির এ আসনসংখ্যা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে ৩২টি কম। এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন বা সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ২৭২টি আসন।
গতকাল এনডিএ জোটের সব শরিকই সরকার গঠনে মোদি ও বিজেপিকে সমর্থন দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। এর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণের অন্ধ্র প্রদেশ রাজ্যের তেলেগু দেশম পার্টি (টিডিপি) ও বিহারের জনতা দল (ইউনাইটেড) বা জেডি (ইউ)। এক্সে (সাবেক টুইটার) এক বিবৃতিতে মোদিকে সর্বসম্মতভাবে এনডিএ জোটের নেতা নির্বাচিত করার কথা জানিয়েছে বিজেপি।
কয়েক ঘণ্টা পর ‘ইন্ডিয়া’জোটের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেওয়ার সময় কংগ্রেসের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেছেন, ‘মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিরোধীরা লড়াই চালিয়ে যাবে।’
গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী বা ভারতের প্রধানমন্ত্রী—যে দায়িত্বেই হোক, ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কাজ করেছেন মোদি। রাজ্য ও দেশ শাসন করেছেন কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা নিয়ে। কখনো জোটের কাছ থেকে চাপে পড়তে হয়নি তাঁকে। তবে এবার লোকসভা নির্বাচনে জিতলেও তাঁর সামনে নতুন এক পরিস্থিতি। তিনি কি এটি সামাল দিতে পারবেন? বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ প্রশ্নের জবাব ভারতের ভবিষ্যৎ সরকারের রূপ গড়ে দিতে পারে।
এ হুমকির বাইরে আগামী সরকার গঠন নিয়ে চলা রাজনৈতিক আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ এক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন বিশ্লেষক ও রাজনীতি–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আর সেটি হলো, শরিকদের কাঁধে ভর করে চলা ভবিষ্যৎ সরকার পরিচালনা করতে পারবেন তো মোদি? যা আগে কখনোই করেননি তিনি।
নয়াদিল্লির গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের (সিপিআর) রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নীলাঞ্জন সরকার এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এটি অজানা।’ তিনি আরও বলেন, ‘মোদি শুধু নিরঙ্কুশ কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা নিয়ে কাজ করা একজন নেতা হিসেবেই পরিচিত।’
এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, ‘“মোদি সরকার” এক বিশেষ ধরনের শাসনব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। শরিকদের সঙ্গে সমঝোতা করা বা বিক্রি হয়ে যাওয়া মোদি আমাদের কাছে পরিচিত নন।’
নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার দিন গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিজেপি সদর দপ্তরে দলের সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন নরেন্দ্র মোদি। এ সময় বিহারে ক্ষমতাসীন জোটের বড় জয়ের পেছনে জেডি (ইউ) নেতা নীতীশ কুমারকে কৃতিত্ব দেন তিনি। যদিও দুই নেতা দীর্ঘদিন ধরেই ‘ভালোবাসা-ঘৃণার’ উত্থান–পতনের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে গেছেন। কখনো এ সম্পর্কে ছেদ ঘটেছে, কখনোবা জোড়া। নীতীশের দল এবার ১২টি আসন পেয়েছে।
জোট সরকারকে ঠিক রাখতে শরিকদের যথেষ্ট দাবিদাওয়া মেটাতে হবে মোদিকে। গত ১০ বছর তিনি যেভাবে দেশ শাসন করে গেছেন, সেভাবে চলতে গেলে তাঁর সামনে এর কোনো বিকল্প নেই, তাঁকে তাঁর দপ্তর খোলা রাখতেই হবে।-নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়, মোদির জীবনীকার
জেডির (ইউ) মতো টিডিপিকেও বিজেপি ও কংগ্রেস—উভয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় লুকোচুরি খেলতে দেখা গেছে। জেডি (ইউ) ও টিডিপি দুই-ই ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবমূর্তি ধরে রেখেছে, মুসলিম ভোটারদের সমর্থন গুরুত্ব দিয়েছে ও বিজেপির হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতি থেকে নিজেদের দূরে রেখেছে; যেটি মোদির বিজেপির আদর্শের বিপরীত। নির্বাচনে টিডিপি পেয়েছে ১৬টি আসন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, মোদিকে একজন শক্তিশালী, ফলাফল নির্ধারণকারী নেতা হিসেবে সফলভাবে তুলে ধরতে পেরেছে বিজেপি; যিনি রাজনীতিকে স্বাভাবিক নীতিতে চলতে দেননি। এটি সম্ভব হয়েছে কারণ, মোদিকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়া কখনো শাসনকাজ চালাতে হয়নি।
২০০১ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতীয় পর্যায়ে প্রথম বিশেষ পরিচিত পান মোদি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে এ রাজ্য ১৩ বছর শাসন করেছেন তিনি। গুজরাট কিংবা জাতীয় পর্যায়, সবখানে উপভোগ করেছেন একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবিধা।
‘নির্বাচনী ফলাফলে ‘‘ব্র্যান্ড মোদি’ ও ‘বড় রকম ধাক্কা খেয়েছে’, বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক রশিদ কিদওয়াই। আবার এ ফলাফল সরকার গঠনে মোদির ওপর তৈরি করেছে ‘জোট রাজনীতির’ চাপ। এটি মোদির ‘নতুন ভারত’কে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে ২০১৪ সালের পূর্ববর্তী সময়ে; যখন ভারতে জোট সরকার ছিল একটা স্বাভাবিক ঘটনা।
কিদওয়াই বলেন, ‘জোট সরকারের চাপ মোকাবিলা করা মোদির জন্য কঠিন হবে। কেননা শরিকদের থাকবে নানা প্রত্যাশা। এর মধ্যে সরকারে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়া একটি।’ বিভিন্ন বিষয়ে মোদির দর–কষাকষি ক্ষমতায়ও নতুন জোট সরকার পরীক্ষা হয়ে দাঁড়াবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, মোদিকে একজন শক্তিশালী, ফলাফল নির্ধারণকারী নেতা হিসেবে সফলভাবে তুলে ধরতে পেরেছে বিজেপি; যিনি রাজনীতিকে স্বাভাবিক নীতিতে চলতে দেননি। এটি সম্ভব হয়েছে কারণ, মোদিকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়া কখনো শাসনকাজ চালাতে হয়নি।
বিজেপির বিরুদ্ধে তার শত্রু-মিত্র উভয়ের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টির অভিযোগ সমালোচকদের। যেমন মিত্র শিবসেনা ও বিরোধী ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি। মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে দুই দলই গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক।
সিপিআরের নীলাঞ্জন সরকার বলেন, শরিকদের দাবি অনুযায়ী মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়ে তাদের সন্তুষ্ট রাখার কাজ নরেন্দ্র মোদিকে চালিয়ে যেতে হবে। যদিও মন্ত্রিসভার পদই সরকারে যথেষ্ট কিছু নয়।
আর মোদির জীবনীকার নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘জোট সরকারকে ঠিক রাখতে শরিকদের যথেষ্ট দাবিদাওয়া মেটাতে হবে মোদিকে। গত ১০ বছর তিনি যেভাবে দেশ শাসন করে গেছেন, সেভাবে চলতে গেলে তাঁর সামনে এর কোনো বিকল্প নেই, তাঁকে তাঁর দপ্তর খোলা রাখতেই হবে।’
‘মোদিকে এমন এক ব্যক্তি হতে হবে, যিনি হবেন বিনয়ী ও অন্যদের সঙ্গে কাজ করার জন্য খোলা মনের অধিকারী, যে রূপে আমরা তাঁকে কখনো দেখিনি’, বলেন নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়।