অবশেষে ‘এক দেশ এক ভোট’ বিল পেশ হলো ভারতের সংসদে। বিরোধীদের প্রবল আপত্তির মধ্যে আজ মঙ্গলবার দুটি বিল লোকসভায় পেশ করেন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী অর্জুন মেঘাওয়াল। তিনি অবশ্য জানিয়েছেন, আরও আলোচনার জন্য সরকার বিল দুটি যুগ্ম সংসদীয় কমিটিতে (জেপিসি) পাঠাতে আগ্রহী। বিল দুটি জেপিসিতে পাঠানোর প্রস্তাব আইনমন্ত্রীকে দেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।
এই বিল আইনে পরিণত হলে লোকসভা ও বিধানসভার পাশাপাশি পৌরসভা ও পঞ্চায়েতের মতো স্থানীয় সরকারের নির্বাচনও একসঙ্গে করা যাবে। সরকারের যুক্তি, তেমন করা গেলে নির্বাচন ঘিরে বিপুল অর্থ ব্যয় যেমন হবে না, তেমনই সর্বস্তরে উন্নয়নমূলক কাজও ব্যাহত হবে না। নির্বাচন ঘোষণার পর আদর্শ আচরণবিধি অনুযায়ী সরকার নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। নতুন উন্নয়নমূলক কাজেও হাত দিতে পারে না। সরকার মনে করে, এতে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ, বছরভর কোথাও না কোথাও ভোটের দরুন উন্নয়ন থমকে থাকে। ফলে প্রকল্প খরচ বেড়ে যায়।
আইনমন্ত্রী এ লক্ষ্যে আজ মঙ্গলবার দুটি বিল পেশ করেন। একটি ১২৯তম সংবিধান সংশোধন বিল, অন্যটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আইন সংশোধন বিল। বিরোধীরা একযোগে এই দুই বিলের বিরোধিতা করেন। তাঁদের বক্তব্য, এই বিল সংবিধানের মূল কাঠামোয় আঘাত হানছে ও সাংবিধানিক আদর্শের পরিপন্থী। তা ছাড়া প্রশ্ন উঠেছে বিল পাস হওয়া নিয়েও। সংবিধান সংশোধন বিল পাস করাতে গেলে দুই কক্ষে দুই–তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতি প্রয়োজন, যা রাজ্যসভায় সরকার পক্ষের নেই। তা যখন নেই, তখন কেন সরকার এই বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছে, সে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
আইনমন্ত্রী এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করে জানান, এই বিল নির্বাচনী সংস্কারের অঙ্গ। এই বিল সংবিধানের মূল কাঠামোর কোনো ক্ষতি করবে না।
বিজেপির নতুন দুই বন্ধু দল অন্ধ্র প্রদেশের তেলুগু দেশম পার্টি ও মহারাষ্ট্রের শিবসেনা এই বিলে সম্মতি জানিয়েছে। তা সত্ত্বেও বিরোধীদের ধারণা, বিজেপির শরিক নয় অথচ অতীতে নানাভাবে তাদের মদদ দেওয়া বিজু জনতা দল বা ওয়াইএসআর কংগ্রেসসহ অনেকেই এই বিলে সম্মতি দেবে না। বিরোধিতা হবে আঁচ করেই সরকার তাই আরও আলোচনার জন্য বিল দুটি জেপিসিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে সেই কমিটিতে শাসক দলের সদস্যরাই বেশি থাকবেন। ৯০ দিনের মধ্যে জেপিসিকে বিলসংক্রান্ত চূড়ান্ত রায় জানাতে হবে।
সংবিধান সংশোধন বিল পাস করাতে গেলে সংসদের দুই কক্ষে দুই–তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতি ছাড়াও দেশের মোট রাজ্যের অর্ধেকের অনুমোদন প্রয়োজন। বিজেপি সেই সমর্থন জোগাড় করতে পারবে কি না, সে বিষয়ে কিছুটা সংশয় এখনো অবশ্যই রয়েছে। তবু তারা এই বিল পাস করাতে উদ্যোগী রাজনৈতিক কারণে। নরেন্দ্র মোদি সরকার দেখাতে চায়, দেশের রাজনৈতিক স্থিরতা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির স্বার্থে কঠিন সংস্কারে তারা কুণ্ঠিত নয়।
অবশ্য বিরোধীদের দাবি, এই বিল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিপন্থী। মোদি সরকার এভাবে দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েমের চেষ্টা করছে।
বিল দুটি পাস হলেও ২০৩৪ সালের আগে দেশের সর্বত্র লোকসভার সঙ্গে বিধানসভার ভোট এবং সেই সঙ্গে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন করানো যাবে না। সদস্যদের কাছে পাঠানো খসড়া বিলে বলা হয়েছে, লোকসভার পরবর্তী ভোটের পর যেদিন প্রথম লোকসভার অধিবেশন বসবে, সেই দিনটিকে ‘অ্যাপয়েন্টেড ডে’ হিসেবে ধরা হবে। নতুন সরকারের মেয়াদ হবে ওই দিন থেকে পাঁচ বছর।
ওই সময় থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হবে পরের লোকসভা ভোটের সঙ্গে সব রাজ্যের বিধানসভা ভোট করানোর। পরবর্তী লোকসভার ভোট ২০২৯ সালের এপ্রিল–মে–জুন মাস নাগাদ হওয়ার কথা। সেই ভোটের পর লোকসভার প্রথম অধিবেশন যেদিন বসবে, সেদিন থেকে পাঁচ বছর হবে ওই সরকারের মেয়াদ। ওই পাঁচ বছরের প্রস্তুতি শেষে একযোগে ভোট নেওয়া হবে। সেই হিসাবে এই বিল কার্যকর হবে ২০৩৪ সাল থেকে। সেই ভোটের ১০০ দিনের মধ্যে পৌরসভা ও পঞ্চায়েতের মতো স্থানীয় প্রশাসনের ভোট করাতে হবে।
ভারতীয় গণতন্ত্রে বহু সময় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারে না। নতুন ব্যবস্থায় তেমন হলে কী উপায়, নতুন বিলে তা–ও জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের পতন ঘটলে নতুন নির্বাচন হবে বাকি সময়ের জন্য। অর্থাৎ, পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার দুই বা তিন বা চার বছর আগে সরকারের পতন ঘটলে ওই বাকি সময়ের জন্য নির্বাচন করা হবে।
‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি চালুর দাবি বিজেপির বহুদিনের। লালকৃষ্ণ আদভানি এই নীতির পক্ষে সরব ছিলেন বাজপেয়ী সরকারের আমলেও। এত বছর বিজেপি যা করতে পারেনি, নরেন্দ্র মোদি তা করতে আগ্রহী। সে কারণে সাবেক রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে তিনি এক কমিটি গঠন করেছিলেন। সেই কমিটিও এই নীতি রূপায়ণের পক্ষে মত দেয়। এখন দেখার, মোদি সরকার লক্ষ্যপূরণে সফল হয় কি না।