জামায়াতে ইসলামি (জেআই) ভারত সরকারের বয়ানে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ সংগঠন বলে চিহ্নিত। তাই এখনো নিষিদ্ধ। একইভাবে চিহ্নিত ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বারামুল্লা থেকে জয়ী লোকসভা সদস্য ইঞ্জিনিয়ার রশিদ। তিনি ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বলে এখনো জেলবন্দী। ভোটে প্রচারের জন্য আদালত অবশ্য তাঁকে জামিন দিয়েছেন। রশিদ নিজের দল গড়েছেন। নাম আওয়ামি ইত্তেহাদ পার্টি (এআইপি)। কাশ্মীর উপত্যকার জনগণের সমর্থন পেতে এ দুই দল জেআই ও এআইপি গতকাল রোববার জোট বেঁধেছে। দক্ষিণ কাশ্মীরের অনন্তনাগ, পুলওয়ামা, শোপিয়ান, কুলগাম ও তাদের পশ্চিমে বারামুল্লায় ভোটের প্রাক্–মুহূর্তে এই জোটবদ্ধতাই সর্বশেষ চমক।
এআইপি ও জেআই এবার মোট ৪৩ আসনে প্রার্থী দিয়েছে। সবাই স্বতন্ত্র। জম্মুতে এই জোট লড়ছে একটিমাত্র কেন্দ্রে। বাকি ৪২ জনই উপত্যকায়।
ঘোষিত এই জোটের বাইরে যা অঘোষিত, তার কেন্দ্রে রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। কিংবা বলা ভালো শাসক দল বিজেপি। রাজনৈতিক প্রচার, জেআই ও ইঞ্জিনিয়ার রশিদের জোটবদ্ধতার অনুঘটক কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, যাঁর লক্ষ্য উপত্যকা থেকে কিছু আসন জেতা, যাতে ভোট শেষে অন্তত একক গরিষ্ঠ দল হিসেবে মাথাচাড়া দেওয়া যায়। তারপর সরকার গড়ার প্রয়োজনীয় সমর্থন পেতে স্বতন্ত্রদের দিকে হাত বাড়ানো যায়।
সেটা জেনেবুঝে ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) নেতা ওমর আবদুল্লাহ প্রচার করছেন, ওই জোটের নেতারা বিজেপির বি–টিম। বিজেপির মদদে এটা তাদের ‘প্রক্সি ওয়ার’।
বিজেপি সরকারিভাবে ওই অভিযোগ অস্বীকার করছে। অস্বীকার করছেন ইঞ্জিনিয়ার রশিদ ও জেআই নেতৃত্বও। কিন্তু তা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না দুটি কারণে। প্রশ্ন উঠছে, সংসদীয় অধিবেশনে যোগ দেওয়ার সাংবিধানিক অধিকার যে আদালত নির্বাচিত সংসদ সদস্যকে (রশিদ) দেননি, তাঁকে কেন নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে জামিন দেওয়া হলো? উত্তরটাও তাঁরা দিচ্ছেন, বিজেপি চাইছে বলে। দ্বিতীয় কারণ, জামায়াতে ইসলামি যাতে ভোটে লড়তে পারে, সে জন্য তাদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে জেআই নেতাদের চারবার বৈঠক হয়েছিল। সেই বৈঠকে যোগ দিয়েছিল জেআইয়ের আট সদস্যের প্রতিনিধিদল। তাদের নেতা গুলাম কাদের ওয়ানি উদ্যোগী হয়ে শেষবেলায় এই জোট গড়েছেন। কেন গড়লেন? তারও উত্তর দিচ্ছেন এনসি নেতারা, সরকার চাইছে বলে।
প্রশ্ন হলো, এতটা ঝুঁকি নিয়ে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের’ সঙ্গে বিজেপির শীর্ষ নেতারা কেন এগোচ্ছেন। এ প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তরও দুটি। প্রথমটি হলো উপত্যকায় বিজেপির ‘শূন্য’ প্রভাব। অনেক চেষ্টা করেও গত ১০ বছরে তারা দাঁত ফোটাতে পারেনি। দ্বিতীয় উত্তর, পরোক্ষে প্রভাব বিস্তারে বিজেপি যে চাল চেলেছিল, প্রতিষ্ঠিত নেতাদের দল ভাঙিয়ে নতুন দল গড়ে তাদের ওপর ভরসা করা, তা ভেস্তে যাওয়া। পিডিপি নেতা আলতাফ বুখারির আপনি পার্টি ও কংগ্রেস নেতা গুলাম নবী আজাদের আজাদ পার্টি যাবতীয় সরকারি মদদ সত্ত্বেও চূড়ান্ত ব্যর্থ। অথচ জেলে থেকে বাজি মাত করলেন ইঞ্জিনিয়ার রশিদ! ওমর আবদুল্লাহকে হারালেন দুই লাখেরও বেশি ভোটে। বিজেপি বুঝল, উপত্যকার সমর্থন যদি অন্য কারও কাছে থাকে, তারা হলো এই বিচ্ছিন্নতাবাদীরাই। তাই তাদেরই তারা আঁকড়ে ধরেছে।
এই জোট সবচেয়ে বেশি চিন্তায় ফেলেছে পিডিপিকে। কারণ, মেহবুবা মুফতির দলের খাসতালুক দক্ষিণ কাশ্মীরই জেআইয়ের মুখ্য বিচরণভূমি। দাপাদাপি সবচেয়ে বেশি ওখানেই। ৩০ বছর ধরে ভোট বর্জন নীতি আঁকড়ে থাকায় জামায়াতের অনেক সমর্থক ভিড় জমিয়েছিল পিডিপিতে। এবার তারা মনে করছে, সেই সমর্থন ঘরে ফিরবে। তেমন হলে ক্ষতি পিডিপিরই। সেই ভোট ভাগাভাগিতে এনসি–কংগ্রেস–সিপিএমের লাভ হবে কি না, সে প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে।
চিন্তায় আছে বিজেপিও। জেআই ও এআইপি প্রার্থীরা স্বতন্ত্র হিসেবে লড়লেও ভোটের পর সরাসরি তাঁদের সমর্থন নেওয়া বিজেপির পক্ষে সম্ভব হবে কি? প্রশ্নটি বড় হচ্ছে, যেহেতু জেআইয়ের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোর বিরোধিতা করেছিল আরএসএস। চিন্তা অন্য এক জায়গাতেও; এই নতুন জোট উপত্যকায় বেশি সমর্থন পেলে আগামী দিনে বিচ্ছিন্নতাবাদের ঢেউ নতুন করে আছড়ে পড়বে কি না, সে ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে দুই দলই যখন ৩৭০ অনুচ্ছেদের বিলোপের বিরুদ্ধে। প্রচারেও তারা বলছে, ‘হৃত মর্যাদা’ পূর্ণভাবে ফিরিয়ে আনাই তাদের লক্ষ্য।
ভবিষ্যৎ যা–ই হোক, ১৮ সেপ্টেম্বর প্রথম পর্বের ভোট শুরুর আগে উপত্যকায় আগ্রহ ও উত্তেজনা তুঙ্গে উঠেছে। আর কিছু হোক না হোক, জম্মু–কাশ্মীরের মানুষ ১০ বছর পর ফিরে পেতে চলেছে নিজেদের সরকার গড়ার অধিকার।