ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় বসবাসরত কানাডার নাগরিক, খালিস্তানপন্থী শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যার তদন্ত প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করতে ভারতের ওপর কূটনৈতিক চাপ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। কানাডার দাবি, শিখদের জন্য খালিস্তান নামে মাতৃভূমির দাবিতে চালিয়ে যাওয়া আন্দোলনের নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যার সঙ্গে ভারত সরকারের এজেন্ট জড়িত।
গত বুধবার সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, ভারতের সঙ্গে কোনো বিতণ্ডা সৃষ্টি হয়, তিনি এমন পরিবেশ তৈরি করতে চান না। কিন্তু ভারত কানাডার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে।
ট্রুডো বলেন, ‘ভারত সরকার কানাডার নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বে আগ্রাসীভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারবে, এমনটা ভেবে ভয়াবহ ভুল করেছে। কানাডীয়দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদের উত্তর দিতে হবে।’
তবে কানাডার সরকার প্রধানের এমন অভিযোগকে ‘অযৌক্তিক ও অসংগত’ বলে অভিহিত করেছে ভারত।
হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে কানাডা ও ভারতের সম্পর্ক এতটাই তিক্ত হয়ে উঠেছে যে দেশ দুটি কূটনীতিকদের নিজ নিজ দেশ থেকে বহিষ্কার করেছে।
গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, ভারতের উচিত কানাডার অভিযোগ ‘গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা’ ও‘কানাডাকে তদন্তে সহায়তা করা’।
এক দিন পর যুক্তরাজ্যের এক বিবৃতিতে বলা হয়, স্বাধীন তদন্তে যে তথ্য উঠে এসেছে, তা নিয়ে কানাডার মিত্রদের সঙ্গে যোগযোগ করছে দেশটি। কানাডার বিচারব্যবস্থার ওপর যুক্তরাজ্যের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। সার্বভৌমত্ব ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র ডয়চে ভেলেকে বলেন, এ বিষয় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে বড় কোনো প্রভাব ফেলবে না।
ওই কূটনীতিক বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আমাদের গভীর ও শক্তিশালী সম্পর্ক রয়েছে। কানাডার অভিযোগের ফলে পশ্চিমা মিত্রদের সঙ্গে আমাদের সহযোগিতার সম্পর্কের অবনতি ঘটবে না।’
অনেকটা একই সুরে কথা বললেন মন্ত্র ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট শান্থি ম্যারিয়েট ডি’সুজা। তাঁর মতে, ওয়াশিংটন ও লন্ডনের সঙ্গে নতুন দিল্লির সম্পর্ক বহুমাত্রিক। কোনো একটি ঘটনা পুরো সম্পর্ককে প্রভাবিত না করার সম্ভাবনাই বেশি।
তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করছেন, সম্পর্ক যা-ই হোক না কেন, এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক পরিসরে ভারতের সুনামকে ক্ষুণ্ন করবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকাতে নয়াদিল্লি শক্তিশালী মিত্র, এমন বিবেচনায় সম্পর্ক মজবুত করার চেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের।
সামরিক খাতেও দেশ দুটি পরস্পরের কাছাকাছি আসছে। গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সামরিক ড্রোন কেনার জন্য ৪০০ কোটি ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে দিল্লি।
সম্পর্ক দৃঢ় করতে এগিয়ে আসছে যুক্তরাজ্যও। এরই মধ্যে ভারত ও যুক্তরাজ্য একটি মুক্ত বাণিজ্যের চুক্তি করার পথে। খুব দ্রুতই এই চুক্তি আলোর মুখ দেখবে বলে জানা গেছে।
সিঙ্গাপুর ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের ভিজিটিং প্রফেসর সি রাজা মোহন বলেন, ফাইভ আইস–এর দেশগুলোর সঙ্গে এখনকার মতো এত ভালো সম্পর্ক কখনোই ভারতের ছিল না। ফাইভ আইস হলো অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে গঠিত একটি গোয়েন্দা জোট।
এই গবেষক অবশ্য শিখ নেতা হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কানাডার অবস্থানের সমালোচনা করেন। তাঁর মতে, বাক্স্বাধীনতার সুরক্ষা দেওয়ার নামে অপরাধী চক্র এবং ভারতবিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি নমনীয় মনোভাব দেখাতে পারে না কানাডা। প্রমাণ ছাড়া অভিযোগ করার পরিবর্তে এমন বিষয় ওই দেশের কর্তৃপক্ষকেই সামলাতে হবে।
কানাডার অভিযোগের পর ভারত যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি দেখানো প্রতিক্রিয়ার চেয়ে পরিষ্কারভাবে ভিন্ন।
ভারতের বিরুদ্ধে এমনই আরেক অভিযোগ এনেছে যুক্তরাষ্ট্র। নিউইয়র্কে খালিস্তানপন্থী আরেক নেতা যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার নাগরিক গুরপতবন্ত সিং পান্নুন হত্যার চেষ্টায় ভারতের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনেছে যুক্তরাষ্ট্র।
ওই ঘটনার তদন্তে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করছে দিল্লি।
মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর জানায়, হত্যার নির্দেশ দেওয়া যেই গুপ্তচরের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা ভারত সরকারের সঙ্গে যুক্ত নয় বলে জানিয়েছে দেশটি।
কানাডায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার অজয় বিসারিয়ার মতে, কানাডার মতো তারা এটিকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে দেয়নি।
অজয় বিসারিয়ার মতে, ফাইভ আইসের কূটনৈতিক জোট গঠনের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পক্ষে কানাডাকে রক্ষা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
তবে বিসারিয়ার মতে, সাম্প্রতিক এসব ঘটনা ভারতের ওপর খুব বড় কোনো প্রভাব ফেলবে না। ভারতের সঙ্গে ভূরাজনৈতিক যেই মিত্রতা, সেটির পুনর্গঠন হবে না। ভারত এসব দেশের বিশ্বস্ত মিত্র।