কাশ্মীরের মালিকানা নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল ১৯৪৮ সালে। একপর্যায়ে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। ওই যুদ্ধবিরতিকে নেহরুর ‘ভুল’ সিদ্ধান্ত বলে দাবি করে আসছে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। ওই যুদ্ধবিরতির বিষয়ে কিছু চিঠি দশকের পর দশক গোপন রাখা হয়েছিল। এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান
১৯৪৮ সাল, ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের হাত থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের পরের বছর। তখন কাশ্মীরের মালিকানা নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলছে লড়াই। এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে যেতে রাজি হন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। এর জের ধরে ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি যুদ্ধ বন্ধ হয়।
নেহরু ছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। ১৯৪৮ সালে তাঁর যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার পেছনে কাজ করেছিল ভারতের সেনাবাহিনীর সে সময়ের প্রধান জেনারেল স্যার ফ্রান্সিস রবার্ট রয় বুচারের তৎপরতা। নেহরুকে লেখা বুচারের কিছু চিঠিতে এমনটাই দেখতে পেয়েছে যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান। দশকের পর দশক গোপনে রাখা হয়েছিল ওই চিঠিগুলো।
জেনারেল বুচারের লেখা ওই চিঠিগুলো ভারতে বর্তমানে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে। কারণ, কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে যাওয়া নেহরুর ‘ভুল’ সিদ্ধান্ত ছিল বলে দাবি করে আসছে তারা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বা স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে বিজেপি সরকার। অঞ্চলটিকে আনা হয় কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে।
নেহরু ছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। ১৯৪৮ সালে তাঁর যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার পেছনে কাজ করেছিল ভারতের সেনাবাহিনীর সে সময়ের প্রধান জেনারেল স্যার ফ্রান্সিস রবার্ট রয় বুচারের তৎপরতা।
বিজেপি সরকার নেহরুর সিদ্ধান্তকে ভুল বললেও চিঠিগুলোয় দেখা যাচ্ছে, এ সিদ্ধান্ত তিনি একা নেননি; বরং তাঁর অত্যন্ত বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচিত জেনারেল বুচারের পরামর্শের ভিত্তিতেই এ কাজ করেছিলেন। এই সেনা কর্মকর্তা সে সময় নেহরুকে সতর্ক করে বলেছিলেন, কাশ্মীরে চলমান সামরিক অভিযান বেশি দিন চালিয়ে যেতে পারবে না ভারত। তাই কাশ্মীর সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন।
নেহরুকে লেখা বুচারের চিঠিগুলোর একটি ১৯৪৮ সালের ২৮ নভেম্বরের। কাশ্মীরে ভারতের সেনারা ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন উল্লেখ করে চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, সেনাসদস্যদের মধ্যে দুটি দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। এ ছাড়া সেনা কর্মকর্তাদের অন্যান্য পদেও অসন্তোষ দেখা দিচ্ছে। এককথায় বলতে গেলে, সেনাসদস্যদের অবকাশ প্রয়োজন।
এর জবাবে লেখা একটি চিঠিতে নেহরু কাশ্মীর নিয়ে কয়েকটি প্রতিবেদনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। ওই প্রতিবেদনগুলোয় বলা হয়েছিল, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নানা অবস্থানে আকাশ থেকে বোমা হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছে পাকিস্তান।
কয়েক দশক ধরে জেনারেল বুচার ও নেহরুর লেখা চিঠিগুলো নয়াদিল্লিতে নেহরু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম অ্যান্ড লাইব্রেরিতে রয়েছে। ১৯৭০ সাল থেকে স্বায়ত্তশাসিত এ প্রতিষ্ঠান ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিচালিত হচ্ছে। সেখান থেকে বেশ কয়েকবার চিঠিগুলো প্রকাশ্যে আনার চেষ্টা করেছেন অনেকে। তবে তা সফল হয়নি।
১৯৪৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর জেনারেল বুচারকে আরেকটি চিঠি লেখেন নেহরু। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘এটা আমার কাছে পরিষ্কার যে কাশ্মীরে রক্ষণাত্মক অবস্থানে থেকে আমরা পাকিস্তানের ওপর ভরসা করতে পারি না।’ তিনি আরও লিখেছিলেন, ‘পাকিস্তান যখন অবিরতভাবে গোলাবর্ষণ করছে, আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে এবং তা সামাল দেওয়ার অবস্থায় আমরা নেই, এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধ বেধে যাওয়ার সব ধরনের আশঙ্কা রয়েছে।’
এর কয়েক দিন পর ২৮ ডিসেম্বর নেহরুকে লেখা একটি চিঠিতে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে বুচার লেখেন, তিনি ভয় পাচ্ছেন যে পাকিস্তানের আক্রমণ সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমে বন্ধ করতে পারবেন না তিনি। নেহরুকে তিনি কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিকভাবে এগোনোর পরামর্শ দেন।
এর পরের বছর ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। বন্ধ হয় দুই দেশের মধ্যকার যুদ্ধ। ওই বছরেই ভারতনিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বা স্বায়ত্তশাসন দেন নেহরু। যদিও এর পরের কয়েক দশকে কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তান আরও তিনটি যুদ্ধে জড়িয়েছিল।
ভারতের সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিলেন নেহরু। এ অনুচ্ছেদ নিজেদের অধিকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখতেন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু ও কাশ্মীরের বাসিন্দারা। বলা চলে, জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার কারণে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে চলমান উত্তেজনাও কমিয়েছিল।
তবে ২০১৯ সালে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়। এ অঞ্চলকে কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনের অধীন আনা হয়। এতে ক্ষোভ ও অসন্তোষ জেগে ওঠে জম্মু ও কাশ্মীরের বাসিন্দাদের মধ্যে।
জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তের বৈধতা দিতে নেহরুকে দোষারোপ করে আসছে বিজেপি। তাদের দাবি, ১৯৪৮ সালে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুল করেছিলেন তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি কাশ্মীরের আরও বেশি ভূখণ্ড পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেননি। ২০১৯ সালে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন, ‘যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করার কী দরকার ছিল, যখন আমরা যুদ্ধে জিততে যাচ্ছিলাম।’
জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তের বৈধতা দিতে নেহরুকে দোষারোপ করে আসছে বিজেপি। তাদের দাবি, ১৯৪৮ সালে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুল করেছিলেন তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি কাশ্মীরের আরও বেশি ভূখণ্ড পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেননি। ২০১৯ সালে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন, ‘যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করার কী দরকার ছিল, যখন আমরা যুদ্ধে জিততে যাচ্ছিলাম।’
তবে জেনারেল বুচারের লেখা চিঠিগুলোয় দেখা গেছে, নেহরু আসলে সে সময় দেশটির শীর্ষ সেনা কর্মকর্তার পরামর্শেই কাজ করছিলেন। গত মাসে গার্ডিয়ান একটি তথ্য সামনে এনেছে। সেখানে দেখা গেছে, এসব চিঠির কয়েকটি যেন প্রকাশিত না হয় সে চেষ্টা করেছে মোদি সরকার। তাদের ভাষ্য, ওই চিঠিগুলো ‘সংবেদনশীল’। গার্ডিয়ানের নজরে আসা ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক একটি নথিতেও বলা হয়েছে, ওই চিঠিগুলোর বিষয়বস্তু এখন প্রকাশ করা উচিত হবে না।
কয়েক দশক ধরে জেনারেল বুচার ও নেহরুর লেখা চিঠিগুলো নয়াদিল্লিতে নেহরু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম অ্যান্ড লাইব্রেরিতে রয়েছে। ১৯৭০ সাল থেকে স্বায়ত্তশাসিত এ প্রতিষ্ঠান ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিচালিত হচ্ছে। সেখান থেকে বেশ কয়েকবার চিঠিগুলো প্রকাশ্যে আনার চেষ্টা করেছেন অনেকে। তবে তা সফল হয়নি। জেনারেল বুচারের লেখা চিঠির কিছু অংশের প্রতিলিপি যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল আর্মি মিউজিয়াম অব লন্ডনেও সংরক্ষিত রয়েছে।