বিরিয়ানি
বিরিয়ানি

ভারতে ইফতারে বিরিয়ানি কেন এত জনপ্রিয়

পবিত্র রমজান মাসে রোজা রাখার পর পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুদের সঙ্গে ইফতার করতে পছন্দ করেন অনেকেই। সেটা বাড়ি হোক কিংবা মসজিদে। ইফতারে ভারতে অনেকেই পাতে একটি বিশেষ খাবার তুলে নিতে পছন্দ করেন। খাবারটি বিরিয়ানি।

বাড়ি কিংবা রেস্তোরাঁ—ইফতারে হরেক পদের রান্না হয়। আর টেবিলে বিরিয়ানি থাকাটা ভিন্ন একটা আমেজ যুক্ত করে। শুধু ভারত নয়, পুরো উপমহাদেশে পবিত্র রমজান মাসে বিরিয়ানির কদর বেড়ে যায়।

বিরিয়ানি জনপ্রিয় করার পেছনে মুমতাজ মহলের ভূমিকার কথা বলেন অনেকে। তিনি মোগল সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রী ছিলেন। ১৭ শতকে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ঐতিহাসিক তাজমহল নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, মুমতাজ মহল একবার সেনা ব্যারাক পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। সেখানে শীর্ণকায় মোগল সেনাদের দেখে তিনি বিশেষ ও সুষম খাবার খাওয়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। সম্রাজ্ঞীর নির্দেশে পরে সেনাদের বিরিয়ানি খাওয়ানো হতো।

সুগন্ধি চালের সঙ্গে হরেক পদের মাংস (মুরগি, গরু, খাসি, ভেড়া) দই, বিভিন্ন মসলা মিশিয়ে রান্না করা হয় বিরিয়ানি। অনেকে আবার চিংড়ি কিংবা মাছ দিয়েও বিরিয়ানি রাঁধেন। এ উপমহাদেশে বিরিয়ানি একটি অভিজাত খাবার হিসেব পরিচিত। একসময় মোগলদের হাত ধরে ভারতবর্ষে আসে রাজকীয় খাবার বিরিয়ানি। তবে এখন খাবারটি ভারতের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে।

অভিজাত আওলাদ পরিবারের সন্তান মনজিলাত ফাতিমা পেশায় আইনজীবী। পাশাপাশি কলকাতায় মনজিলাত’স রেস্টুরেন্ট নামে একটি রেস্তোরাঁ চালান তিনি। ফাতিমা বলেন, বিরিয়ানি এমন একটি খাবার, যার সঙ্গে আর কিছু খাওয়ার দরকার পড়ে না। সঙ্গে শুধু একটুখানি পুদিনার রায়তা হলেই চলে। সারা বছরই মানুষ বিরিয়ানি খেতে পছন্দ করেন। তবে উৎসব-আয়োজনে কদর বেড়ে যায়।

ফাতিমা আরও বলেন, রোজায় ইফতারে বিরিয়ানি খেতে বেশি পছন্দ করে মানুষ। কেননা এ সময় মানুষ এমন খাবার খোঁজেন যেটা তৃপ্তিদায়ক, সহজে রান্না করা ও খাওয়া যায়।

১৮৫৬ সালে আওয়াধের দশম নবাব ওয়াজিদ আলি শাহকে ব্রিটিশরা নির্বাসনে পাঠান। তিনি লক্ষ্ণৌ থেকে কলকাতায় চরে আসেন। সঙ্গে আনেন বিরিয়ানি রান্নার কৌশল। তিনি কলকাতার বাবুর্চিদের বিরিয়ানিতে আলু যোগ করতে বলেন। ভারতজুড়ে এখন আলু খুবই সাধারণ ও প্রচলিত একটি সবজি। কিন্তু তখন ভারতীয়দের রসুইঘরে আলু এতটা প্রচলিত ছিল না।

ভারতীয় উপমহাদেশে বিরিয়ানির ইতিহাস খুঁজতে গেলে বহু শতাব্দী আগে যেতে হবে। ২০১৭ সালে প্রকাশিত নিজের কুকবুকে প্রতিভা কারণ লিখেছেন, ১৬ শতকে মুসলিম শাসকেরা ভারতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ওই সময় তাঁরা পারস্য থেকে ভারতবর্ষে বিরিয়ানি বানানোর কৌশল নিয়ে আসেন। বিরিয়ানি শব্দটি ফারসি ‘বিরিঞ্জ’ শব্দ থেকে এসেছে। এটি ভাতের ফারসি প্রতিশব্দ। মূলত রাজা-অভিজাত ব্যক্তিদের জন্য জাফরান ও ক্রিমের মতো দামি উপাদান মিশিয়ে এই খাবার রান্না করা হতো।

বিরিয়ানি জনপ্রিয় করার পেছনে মুমতাজ মহলের ভূমিকার কথা বলেন অনেকে। তিনি মোগল সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রী ছিলেন। ১৭ শতকে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ঐতিহাসিক তাজমহল নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, মুমতাজ মহল একবার সেনা ব্যারাক পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। সেখানে শীর্ণকায় মোগল সেনাদের দেখে তিনি বিশেষ ও সুষম খাবার খাওয়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। সম্রাজ্ঞীর নির্দেশে পরে সেনাদের বিরিয়ানি খাওয়ানো হতো।

তবে বেশির ভাগ খাবারবিশারদ ও পুষ্টিবিদেরা মনে করেন, বিরিয়ানির উৎপত্তি ইরানে। পরে সেখান থেকে নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে খাবারটি। মূলত বিরিয়ানি বানানোর উপাদান দেখে তাঁরা মনে করেন যে এটা ইরানের খাবার।

যুক্তরাষ্ট্রে বিরিয়ানি ও কাবাবের ক্যাটারিং ব্যবসায়ী হালা পারভেজ বলেন, ফারসি শব্দ বিরিঞ্জ থেকেই বিরিয়ানি শব্দ এসেছে। এর অর্থ ফ্রায়েড রাইস। তিনি বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশ সমৃদ্ধ এ খাবারটিকে নিজেদের করে নিয়েছে। সেই সঙ্গে এটিকে আঞ্চলিকভাবে রান্না করে ৫০০টির মতো বৈচিত্র্য তৈরি করেছে।

মোগলদের হাত ধরে ভারতে বিরিয়ানি রান্নার কৌশল ও উপাদান—দুটিই আসে। কোমল হলুদ রং ও সুগন্ধির জন্য মোগলরা এতে জাফরান মিশিয়েছিল। আর স্বাদ বাড়াতে ব্যবহার করত দই। মোগলরাই শিখিয়েছিল, কীভাবে কম আঁচে, মুখবদ্ধ পাত্রে চাল, মসলা আর মাংসের মিশেলে ধীরে ধীরে বিরিয়ানি রান্না করতে হয়। এ কৌশলকে বলা হয়, ‘দমে রাখা’।

১৮ শতকে এসে আওয়াধ রাজ্য ও হায়দরাবাদের রাজকীয় বাবুর্চিরা বিরিয়ানি রান্নার নিখুঁত কৌশল বের করেছিলেন। তবে ভারতবর্ষের অন্যান্য এলাকার মানুষ বিরিয়ানির নিজস্ব স্বাদ পেতে নিজস্ব উপাদান যোগ করে স্বতন্ত্র রন্ধনকৌশল উদ্ভাবন করেছিল।

আওয়াধি বিরিয়ানি ভারতে জনপ্রিয় বিরিয়ানিগুলোর অন্যতম। ফাতিমা বলেন, ১৭৮৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় আওয়াধের মুসলিম নবাব আসাফ-উদ-দৌলা লক্ষ্ণৌতে ‘আসাফি ইমামবারা’ নির্মাণ শুরু করান। ওই সময় কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত ২০ হাজার শ্রমিককে চাল দিয়ে তৈরি একধরনের ভারী খাবার দেওয়া হতো। যাতে বিশেষ এ খাবার খেয়ে শ্রমিকেরা দীর্ঘক্ষণ কাজ করতে পারেন। দীর্ঘ সময় তাঁদের পেট ভরা থাকে। এটা ছিল বিরিয়ানি।

ফাতিমা আরও বলেন, শ্রমিকদের জন্য রান্না করা বিরিয়ানির ঘ্রাণ নবাবকেও মুগ্ধ করেছিল। বিরিয়ানিতে মজেছিলেন তিনিও। নবাবের পাতে ওঠার মধ্য দিয়ে বিরিয়ানি অচিরেই রাজকীয় মর্যাদা লাভ করে। যদিও নবাবের পাতে দেওয়ার জন্য বিরিয়ানি থেকে শাকসবজি বাদ দেওয়া হয়েছিল। আর স্বাদ বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল ক্রিম ও জাফরান।

১৮৫৬ সালে আওয়াধের দশম নবাব ওয়াজিদ আলি শাহকে ব্রিটিশরা নির্বাসনে পাঠান। তিনি লক্ষ্ণৌ থেকে কলকাতায় চরে আসেন। সঙ্গে আনেন বিরিয়ানি রান্নার কৌশল। তিনি কলকাতার বাবুর্চিদের বিরিয়ানিতে আলু যোগ করতে বলেন। ভারতজুড়ে এখন আলু খুবই সাধারণ ও প্রচলিত একটি সবজি। কিন্তু তখন ভারতীয়দের রসুইঘরে আলু এতটা প্রচলিত ছিল না।

এখন ভারতীয়দের কাছে বছরজুড়ে বিরিয়ানি খুবই জনপ্রিয় খাবার। ভারতে অনলাইনে খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সুইগি বলছে, তাদের প্ল্যাটফর্মে নানা পদের খাবার সরবরাহ করা হয়। তবে টানা আট বছর ধরে সবচেয়ে বেশি অর্ডার আসছে বিরিয়ানির। ২০২৩ সালে সুইগি প্রতি মিনিটে ১৫০টি বিরিয়ানির অর্ডার পেয়েছে।