গাড়ির নিচে আটকা অঞ্জলিকে টেনে নেওয়া হয় ১৩ কিলোমিটার

দিল্লি গভর্নরের সরকারি বাসভবনের বাইরে এএপির সমর্থকদের বিক্ষোভ। নিউদিল্লি, ২ জানুয়ারি
ছবি: এএনআই

শনিবার সন্ধ্যায় নতুন বছর উদ্‌যাপনের পার্টিতে গিয়েছিলেন অঞ্জলি সিং ও তাঁর বন্ধু নিধি। পার্টিটি হচ্ছিল ওয়ো হোটেলে। সেখান থেকে বেরিয়ে ১৫ মিনিট পর ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় প্রাণ যায় অঞ্জলির।

রাত দুইটার দিকে সুলতানপুরি এলাকায় একটি গাড়ি অঞ্জলি ও নিধিকে বহনকারী স্কুটারটিকে ধাক্কা দেয়। এতে অঞ্জলি ছিটকে পড়ে তাঁর পা গাড়ির সামনের এক্সেলে আটকে যায়। এ অবস্থায় গাড়িটি এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে প্রায় ১৩ কিলোমিটার রাস্তা তাঁকে হিঁচড়ে নিয়ে চলে। এ সময় গাড়িটি দুবার ইউটার্নও নেয়। তৃতীয় ইউটার্নটি নেওয়ার সময় অঞ্জলির শরীরটি গাড়ি থেকে ছুটে যায়।

কী হয়েছিল

পুলিশ বলছে, ওই রাতেই দুটি ফোনকল পাওয়ার পর তারা গাড়িটির খোঁজে নামে। একটি কলে বলা হয়, একজন নারীকে মারুতি বালেনো গাড়ি টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আর অপর কলে বলা হয়, উত্তর দিল্লির একটি রাস্তায় একজন নারীর মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
পুলিশ গাড়িটিকে জব্দ করেছে পাশাপাশি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করেছে।

জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা সাগর প্রীত হোদা বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক হত্যাকাণ্ড এবং অবহেলার কারণে মৃত্যুর অভিযোগ আনা হয়েছে।

গাড়িতে থাকা পাঁচজন ওই সময় মদ্যপান করছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়। তাঁদের ভাষ্য, স্কুটারটিকে ধাক্কা দেওয়ার পর তাঁরা ভয়ে পালিয়ে যান। গাড়িটি ওই তরুণীকে নিয়ে ১৩ কিলোমিটার রাস্তা যাওয়ার পর কানঝাওয়ালার একটি ইউটার্ন নেওয়ার সময় তাঁদের মধ্যে একজন খেয়াল করেন, গাড়ির নিচ থেকে একটি হাত বের হয়ে আছে। তাঁরা সেখানে গাড়ি থামিয়ে ওই তরুণীকে বের করে রেখে সেখান থেকে সটকে পড়েন।

পুলিশ জানিয়েছে, ৩১ ডিসেম্বর থেকে ১ জানুয়ারির মধ্যবর্তী রাতে চালানোর জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিরা গাড়িটি বন্ধুর কাছ থেকে ধার নিয়েছিলেন। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন দীপক খান্না। তিনি বলেছেন, তাঁর মনে হচ্ছিল, গাড়ির নিচে কিছু আটকে গেছে। তবে অন্যরা কিছু হয়নি বলে তাঁকে আশ্বস্ত করে গাড়ি চালিয়ে যেতে বলেন।

সাংবাদিকদের ঘটনা সম্পর্কে ব্রিফ করেন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা সাগর প্রীত হোদা

পুলিশ বলছে, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ঘটনাস্থলে নিয়ে গিয়ে ‘ঘটনার বিবরণ’ শোনা হবে এবং গাড়িটি ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দল দিয়ে পরীক্ষা করা হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা দাবি করেছেন, তাঁরা ওই তরুণীর চিৎকার শুনতে পাননি। কারণ, গাড়িতে উচ্চ স্বরে গান বাজছিল। বিষয়টি পরীক্ষা করার জন্য ডামি ব্যবহার করা হবে।

ভিডিও ফুটেজে যা দেখা গেল

ওয়ো হোটেলের এক কর্মী এনডিটিভিকে বলেন, ‘তারা দুজন ঝগড়া করছিল। পরে ম্যানেজার তাদের চলে যেতে বলেন। তারা তাদের স্কুটিতে করে চলে যান।’ এ দুর্ঘটনার পর থেকে হোটেলটি বন্ধ রয়েছে।

পাশের হোটেল রোহানির সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, ওয়ো হোটেলের সামনেই দুই বন্ধুর মধ্যে ঝগড়া ও ধাক্কাধাক্কি হয়। একপর্যায়ে হোটেল স্টাফ তাঁদের সেখান থেকে চলে যেতে বলেন।

আরেকটি ফুটেজে দেখা যায়, নিধি স্কুটার চালাচ্ছেন। পেছনে অঞ্জলি। এর কিছুক্ষণ পর দুজনের আসন পরিবর্তন হতে দেখা যায়।

নিধির জবানবন্দি

ওই স্কুটারে আরও একজন ছিলেন, তা পুলিশ প্রাথমিকভাবে জানতে পারেনি। পরে হোটেল রেজিস্ট্রার ও সিসিটিভি ফুটেজ দেখার পর পুলিশ নিধির উপস্থিতি জানতে পারে।

নিধি বলেন, দুর্ঘটনার পর তিনি ভয়ে সেখান থেকে চলে আসেন। ভয়ে এ নিয়ে তিনি কাউকে কিছু বলেননি। নিধি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, গাড়িচালকের ভুল ছিল। গাড়িটির ধাক্কায় স্কুটারটি দুমড়েমুচড়ে যায়। সংঘর্ষের পর অঞ্জলি গাড়ির সামনে পড়ে যান, আর তিনি (নিধি) অন্য পাশে। তাঁর গায়ে কোনো আঘাতও লাগেনি। তিনি সেখানে সরে পড়েন।

পরিবার কী বলছে

ওই তরুণীর স্বজনেরা বলেন, পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি এই তরুণী। তাঁদের অভিযোগ, হত্যার আগে তাঁকে যৌন নিপীড়ন করা হয়েছে। টাইম অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়, তরুণীর মা প্রশ্ন তুলেছেন, কেন মরদেহটি বিবস্ত্র অবস্থায় ছিল? আর তাঁর চাচার কাছে মরদেহ দেখে মনে হয়েছে, ‘তাকে যৌন নির্যাতন’ করা হয়েছে।

পুলিশ যখন অঞ্জলির মরদেহ পায়, তখন তাঁর শরীরে কোনো কাপড় ছিল না। তাঁর গায়ের চামড়া উঠে গিয়েছিল।

অভিযুক্ত পাঁচজনের একজন বিজেপির সদস্য। সাক্সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তারা ‘ইচ্ছাকৃতভাবে তথ্য গোপন করছে’।
সৌরভ ভরদ্বাজ , এএপির মুখপাত্র

গতকাল সোমবার স্থানীয় বাসিন্দা ও তরুণীর স্বজনেরা সুলতানপুরি পুলিশ স্টেশনের বাইরে বিক্ষোভ করেছেন। তাঁরা এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের পাশাপাশি অন্যায়ের বিচার দাবি করেন।

ওই তরুণীর মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য দিল্লিতে মাওলানা আজাদ মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠানো হয়। এ জন্য একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নতুন করে অভিযোগ আনা হবে।

তবে ময়নাতদন্তে তাঁর গোপনাঙ্গে কোনো ধরনের ক্ষত পাওয়া যায়নি। তাই যৌন নির্যাতনের অভিযোগ বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। তবে আরও পরীক্ষার জন্য তাঁর সোয়াবের নমুনা ও জিনস প্যান্টের টুকরা সংরক্ষণ করা হয়েছে।

রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত

এ ঘটনায় রাজধানীতেও রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। দিল্লির ক্ষমতাসীন দল আম আদমি পার্টি শহরের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে দুর্বল দাবি করে কেন্দ্রীয় সরকারকে দুষছে। নগর পুলিশ বাহিনীর ওপর এএপির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বাহিনীটি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন।

গতকাল সোমবার দলটির সদস্যরা লে. গভর্নর ভিকে সাকসেনার দপ্তরের বাইরে তাঁর পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন। কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে দিল্লির লে. গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।

এএপির মুখপাত্র সৌরভ ভরদ্বাজ গণমাধ্যমকে বলেন, অভিযুক্ত পাঁচজনের একজন বিজেপির সদস্য। তিনি অভিযোগ করেন, সাক্সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তারা ‘ইচ্ছাকৃতভাবে তথ্য গোপন করছে’।

আজ সকালে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল টুইট করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান এবং বলেন, রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁদের উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগ থাকলেও তাঁদের প্রতি কোনো নমনীয়তা দেখানো উচিত নয়।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এ সমালোচনার সরাসরি জবাব দেননি। তবে তিনি পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং ঘটনার দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এদিকে সাকসেনা বলেছেন, তিনি তদন্তের তত্ত্বাবধান করছেন। তিনি এর আগে বলেছিলেন, ‘অপরাধীদের নির্মম অসংবেদনশীলতা’ দেখে তিনি হতবাক এবং এই ‘অমানবিক আচরণে’ লজ্জায় তাঁর মাথা নিচু হয়ে গেছে।