বিরোধী ঐক্য জোরদার করতে কংগ্রেস একাকী সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধান্বিত। এই দ্বিধার জন্য লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার বিষয়টি কংগ্রেস নতুনভাবে ভেবে দেখছে। কংগ্রেস চাইছে না, এমন কিছু করতে যাতে বিরোধীদের মধ্যে ঐক্যের ফাটল দেখা যায়।
লোকসভার স্পিকার ও রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের সভা পরিচালনাকে কেন্দ্র করে কংগ্রেসসহ প্রায় সব বিরোধী দলই অখুশি। যে নিরপেক্ষতা সভার পরিচালকদের দেখানো উচিত, তা একেবারেই দেখানো হচ্ছে না বলে বিরোধীরা একমত। যেভাবে ও যে গতিতে রাহুল গান্ধীর সদস্য পদ খারিজ করা হয়েছে, আদানি–কাণ্ডসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার দাবি নস্যাৎ করা হচ্ছে, বিরোধীদের বক্তব্য বাদ দেওয়া হচ্ছে, বক্তব্য দেওয়ার সময় মাইক বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে অথবা সরকারের চাপে অধিবেশন মুলতুবি করে দেওয়া হচ্ছে, তাতে সবাই ক্ষুব্ধ।
এমন পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের কেউ কেউ মনে করছেন, স্পিকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে পারলে আর কিছু না হোক, বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে। কিন্তু কংগ্রেস চাইছে না নিজের সিদ্ধান্ত অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিতে। এমন কিছু করতে চাইছে না, যাতে বিরোধীরা এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। এআইসিসির এক শীর্ষ নেতার কথায়, এখন একলা চলার যৌক্তিকতা নেই। সবাইকে নিয়েই এগোতে হবে।
স্পিকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার জোর দাবি জানানো দুই নেতার নাম উঠে এসেছে। কংগ্রেস সূত্র অনুযায়ী, দলীয় সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের ডাকা বৈঠকে সাবেক অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম ও পাঞ্জাবের এমপি মণীশ তিওয়ারি অনাস্থা প্রস্তাব আনার পক্ষে যুক্তি দেখান। তাঁরা বলেন, প্রস্তাব গৃহীত হলেও পাস হবে না। সেই সংখ্যা বিরোধীদের নেই। কিন্তু এই অবসরে ‘গণতন্ত্রহীনতা’, স্পিকারের ‘পক্ষপাতিত্ব’ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ যেসব বিষয় বিরোধীরা তুলতে পারছেন না, সেসবের অবতারণা করা যাবে। এর মধ্য দিয়ে দেশবাসীকে স্পষ্ট বার্তা যেমন দেওয়া যাবে, একই সঙ্গে তা সভার কার্যবিবরণীতেও লিপিবদ্ধ থাকবে। অনাস্থার পক্ষে থাকা নেতাদের মতে এই পদক্ষেপ পুরোপুরি রাজনৈতিক কৌশলগত।
কিন্তু সেই প্রশ্নে প্রবল আপত্তি তৃণমূল কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি ও ডিএমকের। তৃণমূল কংগ্রেসের এক এমপির কথায়, ‘এ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে কংগ্রেসের কোনো আলোচনাই হয়নি। অনাস্থা প্রস্তাবে আমাদের সায় নেই।’
আম আদমি পার্টি ও ডিএমকে মনে করে, যে প্রস্তাব ভোটাভুটিতে টিকবে না, তা আনার অর্থ লোক হাসানো। সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরিও এই প্রস্তাব নিয়ে সন্দিহান। কংগ্রেসকে তাঁর পরামর্শ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে যেন সবার সঙ্গে কথা বলা হয়। যা কিছু করা হবে, সবার সম্মতিতে হওয়া উচিত। এ পরিস্থিতিতে বুধবার কংগ্রেসকে দ্বিধান্বিত মনে হয়েছে। দলের অনেকেই মনে করছেন, অনেক জল ঘোলা হওয়ার পর ১৯টি দল এক জায়গায় আসতে পেরেছে। এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে মনে হয় বিজেপি–বিরোধী ঐক্য ‘সোনার পাথরবাটি’র মতোই অবাস্তব ও হাস্যকর।
সংসদীয় ভারতের ইতিহাসে স্পিকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের নোটিশ একাধিকবার পেশ করা হয়েছে। লোকসভার প্রথম স্পিকার গণেশ বাসুদেব মভলংকরের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করা হয়েছিল। তবে তা পরাস্ত হয়। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসের আমলে লোকসভার স্পিকার ছিলেন বলরাম জাখর। বফর্স বিতর্কের সময় তাঁর বিরুদ্ধেও অনাস্থা প্রস্তাবের নোটিশ দিয়েছিল বিরোধীরা। তবে তা গ্রহণ ও আলোচনার আগেই সরকারবিরোধী পক্ষে মিটমাট হয়ে যায়। আজ পর্যন্ত কোনো স্পিকারকেই অনাস্থার দরুণ পদচ্যুত হতে হয়নি।
নিয়ম অনুযায়ী স্পিকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করতে হলে অন্তত ৫০ সদস্যের সই প্রয়োজন। প্রস্তাব পেশ ও গৃহীত হলে ১৪ দিনের মধ্যে তা নিয়ে আলোচনার জন্য লোকসভার বিশেষ অধিবেশন ডাকতে হবে। প্রস্তাব পেশ ও গ্রহণের শর্ত হিসেবে সভা স্বাভাবিকভাবে চলা বাধ্যতামূলক।
সংসদের বাজেট অধিবেশন শেষ হবে আগামী ৪ এপ্রিল। এ অবস্থায় বুধবার ঘোষণা করা হয়েছে কর্ণাটক বিধানসভা ভোটের তফসিল। ১০ মে নির্বাচন। ফল ঘোষণা ১৩ মে। কাজেই সরকার ও বিরোধী দুই পক্ষেরই মূল ‘ফোকাস’ চলে যাচ্ছে দক্ষিণি এই রাজ্যে। এত দিন অনুৎসাহী থাকলেও কর্ণাটকে প্রচারে রাহুল গান্ধী বাড়তি উৎসাহ নিচ্ছেন। প্রদেশ সভাপতি ডি কে শিবকুমার জানিয়েছেন, যে জনসভায় রাহুলের ‘মোদি’ উক্তি নিয়ে মামলা, কোলার জেলার সেই ময়দান থেকেই আগামী মাসে রাহুল শুরু করবেন কর্ণাটকের প্রচারাভিযান। ৫ এপ্রিল হবে সেই সভা। শিবকুমার জানিয়েছেন, সেই জনসভার নাম দেওয়া হচ্ছে ‘সত্যমেভ জয়তে সমাবেশ’।
মোদি–আদানি সম্পর্ক নিয়ে কংগ্রেস ইতিমধ্যে মোট ১০০টি প্রশ্ন সরকারের কাছে রেখেছে। একটি প্রশ্নেরও জবাব সরকার দেয়নি। বিজেপিও দেয়নি। ওই ১০০টি প্রশ্ন নিয়ে কংগ্রেস একটি পুস্তিকা প্রকাশ করবে। কর্ণাটকের প্রচারে তো অবশ্যই, সারা দেশের সর্বত্র ওই পুস্তিকা কংগ্রেস পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে জন্য দলীয় কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে।
পাশাপাশি চলছে রাহুলের এমপি পদ খারিজের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি। কংগ্রেস এ নিয়ে তাড়াহুড়া করতে চাইছে না। দলের নেতাদের দাবি, যে গতিতে রায় এসেছে, যত দ্রুত রায় কার্যকর হয়েছে, যেভাবে রাহুলের সদস্য পদ খারিজ করা হয়েছে, তাতে স্পষ্ট যে গোটা প্রচেষ্টাই ছিল রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক। উচ্চতর আদালত তার সুবিচার করবেন।
লোকসভার সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল পি ডি আচারিয়া বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, একজন এমপির সদস্য পদ খারিজ করতে গেলে রাষ্ট্রপতির সম্মতি প্রয়োজন। রাহুল গান্ধীর ক্ষেত্রে সেই সম্মতি নেওয়া হয়নি। লোকসভা সচিবালয় নিজ উদ্যোগে তাঁর সদস্য পদ খারিজ করেছে।