ছোটবেলা থেকেই মানুষের জীবন রক্ষায় কাজ করার স্বপ্ন দেখতেন আর জি কর হাসপাতালের নারী চিকিৎসক রাধিকা (ছদ্ম নাম)। কিন্তু হাসপাতালের ভেতরে তাঁরই এক সহকর্মী ধর্ষণের পর খুনের শিকার হওয়ার পর আতঙ্কিত রাধিকা এখন নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
৯ আগস্ট উত্তর কলকাতার আর জি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সভাকক্ষে এক নারী চিকিৎসকের মরদেহ পাওয়া যায়। ময়নাতদন্তে বলা হয়েছে, ওই নারী চিকিৎসককে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর শরীরের বাইরের অংশে ১৬টি ও ভেতরে ৯টি ক্ষতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। যৌন নির্যাতনেরও আলামত পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে সঞ্জয় রায় নামের কলকাতা পুলিশের এক সদস্যকে আটক করেছে পুলিশ।
সরকার পরিচালিত ওই হাসপাতালে নারী চিকিৎসকের মৃতদেহ উদ্ধারের দিন থেকেই বিচারের দাবিতে বিক্ষোভে নামেন চিকিৎসকেরা। পরে সমাজের সব স্তরের মানুষ ওই বিক্ষোভে যোগ দেন।
নারীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা ও নিরাপত্তার পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবিও ওঠে।
রাধিকা বলেন, ‘এই ঘটনা ঘটার মাত্র দুই দিন আগে আমি রাতের পালায় কাজ করেছিলাম। ‘তিনি (নিহত নারী চিকিৎসক) যা করেছেন, আমাদের যে কেউই ওই কাজই করবেন...আমরা সুযোগ পেলে হাসপাতালে একটু বিশ্রাম নিই।’
নিহত ওই নারী চিকিৎসকের নাম প্রকাশ করা হয়নি। বিক্ষোভকারীরা তাঁর নাম দিয়েছেন ‘অভয়া’।
ওই নারী চিকিৎসক দীর্ঘ সময় ধরে টানা দায়িত্ব পালন করছিলেন। কাজের ফাঁকে সামান্য বিশ্রাম নিতে তিনি সেই রাতে হাসপাতালের সভাকক্ষে গিয়েছিলেন বলে জানা গেছে।
নিরাপত্তার শঙ্কায় নিজের আসল নাম প্রকাশ না করা রাধিকা বলেন, যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা টানা কাজ করে যেত হয়...খাওয়ার সময় বা বিশ্রামের সুযোগ বলতে গেলে পাওয়াই যায় না...সেই পরিস্থিতিতে ফাঁকা জায়গায় একটু বিশ্রাম নিতে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
রাধিকা বলেন, ‘এটা আমাদের যে কারও সঙ্গে ঘটতে পারত এবং এখনো যে কারও সঙ্গে ঘটতে পারে।’
সমাজকল্যাণমূলক কাজ করা সংস্থা দশরার তথ্যানুযায়ী, ভারতে প্রায় ৩০ শতাংশ চিকিৎসক নারী। আর নার্সদের মধ্যে ৮০ শতাংশ নারী।
ভারতে নারী চিকিৎসাকর্মীদের ওপর হামলা খুবই সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
অভয়া ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের পর গতকাল মঙ্গলবার ভারতের সুপ্রিম কোর্ট স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা জোরদার করতে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, তা খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দিয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, ‘চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তাজনিত বিধিবিধানের অভাব রয়েছে, চিকিৎসাকর্মীদের ওপর সহিংসতা এবং যৌন সহিংসতা উভয়ই গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে।’
বেঙ্গালুরুর কে সি জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল সুপারিনটেনডেন্ট ইন্দিরা কাবাদে বলেন, তাঁর হাসপাতালের নারী কর্মীরা নিরাপদে বাড়িতে ফিরতে পারলেন কি না, সেটা নিয়েও তিনি উদ্বিগ্ন থাকেন।
ইন্দিরা বলেন, ‘হাসপাতাল থেকেই কেউ তাঁকে অনুসরণ করছেন কি না, আমরা তা–ও জানতে পারব না’।
মেডিকেল সুপারিনটেনডেন্ট ও তাঁর অনেক নারী সহকর্মী তাই হাসপাতাল প্রাঙ্গণে ‘বিমানবন্দরের মতো নিরাপত্তা তল্লাশি’ এবং ভেতরে ‘পুলিশ পোস্টিং’ চান।
ইন্দিরা বলেন, ‘আমরা জীবন বাঁচাতে বিরতিহীনভাবে কাজ করে যাওয়া সত্ত্বেও কাজের জায়গায় নিরাপত্তা নিয়েও আমাদের ভাবাও প্রয়োজন।’
১৪০ কোটি মানুষের দেশ ভারতে ২০২২ সালে দিনে গড়ে প্রায় ৯০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
হাসপাতালগুলোয় নারী কর্মীদের বেহাল চিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে রাধিকা বলেন, বিরতিহীন কাজের চাপে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত চিকিৎসকেরা যেখানে পারেন, সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েন। তাঁরা চেয়ারে, এমনকি মেঝেতেও ঘুমিয়ে যান।
রাধিকা বলেন, তাঁরা এতটাই ক্লান্ত থাকে যে তাঁদের শরীর আর এক পাও চলতে চায় না।
অনেক হাসপাতালে নারী চিকিৎসকদের জন্য আলাদা বিশ্রামের ঘরও থাকে না। নারী-পুরুষ উভয়ই বিশ্রামের জন্য একই কক্ষ ব্যবহার করে। কোনো কোনোটিতে তো দরজা আটকানোর ব্যবস্থাও থাকে না।
নিজের এমন একটি অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে রাধিকা বলেন, ‘একবার আমি বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। হঠাৎ দুজন পুরুষ ওই কক্ষে ঢুকে পড়েন। আমি খুবই ভয় পেয়েছিলাম।’
এমনকি কোনো কোনো হাসপাতালে নারী ও পুরুষ চিকিৎসকদের একই শৌচাগার ব্যবহার করতে হয়।
নারী চিকিৎসকদের প্রতিদিনই নিপীড়নের শিকার হতে হয় বলে জানান কেরালা রাজ্যের একজন নারী চিকিৎসক। বলেন, তাঁকে ও তাঁর নারী সহকর্মীদের ‘কথায় কথায় অপমান করা হয়, শারীরিক নিপীড়ন করা হয়।’
‘এসবের যেন কোনো শেষ নেই। কেউ কেউ চিকিৎসকদের ঈশ্বর বা ফেরেশতা বলেন। তাই আমরা ভাবি অপরাধ বুঝি চিকিৎসকদের ছুঁতে পারে না। আর যখন এসব অপরাধ আমাদের কর্মক্ষেত্রে ঘটে, যেটিকে আমরা সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা বলে ভাবি, আমরা সত্যিই তখন আতঙ্কিত হয়ে পড়ি।’—বলেন রাধিকা
নিরাপত্তা নিয়ে এত উদ্বেগের পরও লড়াই চালিয়ে যাওয়ার এবং মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাওয়ার পণ করেছেন রাধিকা।