কলকাতা হাইকোর্টে বাংলাদেশে আদানি সংস্থার বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রকল্প নিয়ে জনস্বার্থ মামলার প্রথম শুনানি হওয়ার কথা ছিল আজ মঙ্গলবার। তবে নথিপত্রের অভাবে শুনানির পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়েছে ২০ ফেব্রুয়ারি।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার, আদানি পাওয়ার লিমিটেড ও আদানি পাওয়ার (ঝাড়খন্ড) লিমিটেডের আইনজীবীরা আজ শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন মামলার পক্ষের অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অব ডেমোক্রেটিক রাইটস (এপিডিআর) এবং কৃষকদের আইনজীবীরাও।
শুনানিতে আদানির দুই প্রতিষ্ঠানের তরফে এক আইনজীবী বলেন, কৃষক ও এপিডিআর হাইকোর্টে যে মামলা করেছে, সেই মামলার আবেদনের কপি পাননি। এপিডিআরের আইনজীবী বলেন, তিনি কপি পাঠিয়েছেন। জবাবে আদানির আইনজীবী বলেন, তাঁরা খালি খাম পেয়েছেন। খামে আবেদনের কপি ছিল না।
এপিডিআরের আইনজীবী প্রতিপক্ষের দাবি নাকচ করে বারবার বলেন, তিনি পিটিশন পাঠিয়েছেন। তবে আদালত আদানির আইনজীবীর কথা মেনে নেন। এপিডিআরের আইনজীবীকে অবিলম্বে আদানিদের আবার কপি পাঠাতে বলেন।
২০ ফেব্রুয়ারি আবার শুনানির দিন ধার্য করেন বিচারপতি। এপিডিআরের আইনজীবী দ্রুত শুনানি চান এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি দিন ঠিক করার অনুরোধ করেন। কিন্তু প্রধান বিচারপতি রাজি হননি। তিন দিনের মধ্যে আদানিদের কপি সার্ভিস করতে এপিডিআরের আইনজীবীকে নির্দেশ দেন আদালত।
বাংলাদেশে আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রকল্পের বিরুদ্ধে গত মঙ্গলবার কলকাতা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা করেন পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ৩০ কৃষক এবং মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর।
ভারত থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ পাঠানোর জন্য ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা জেলায় আদানি গোষ্ঠী ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ প্রকল্প বানিয়েছে। ঝাড়খন্ডের এই বিদ্যুৎ প্রকল্পটি ‘আলট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কোল-বেজড পাওয়ার প্ল্যান্ট’; অর্থাৎ কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নিয়ে ঝাড়খন্ডে পরিবেশবিদেরা অতীতে প্রশ্ন তুলেছেন।
গোড্ডা থেকে বিদ্যুৎ মুর্শিদাবাদের ফারাক্কাসহ উত্তর পশ্চিমবঙ্গের একাধিক জেলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যাবে। এ জন্য বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুতের তার ফারাক্কার কিছু গ্রামের ওপর দিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে আদানির বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহকারী সংস্থা। বিষয়টি নিয়ে ২০২২ সালের জুলাইয়ে ফারাক্কায় গ্রামবাসীর সঙ্গে আদানির কর্মী ও পুলিশের সংঘর্ষ হয়।
ফারাক্কায় এই আন্দোলনের পরই সেখানে একটি অনুসন্ধানী দল পাঠায় বলে এপিডিআরের সাধারণ সম্পাদক রঞ্জিত শুর প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে এপিডিআর একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করে।
রঞ্জিত শুর বলেন, তখন থেকেই এই জনস্বার্থ মামলার প্রস্তুতি শুরু হয়। গত মঙ্গলবার মামলা করা হয়। এর সঙ্গে হিন্ডেনবার্গ প্রতিবেদনের কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁদের মামলা মূলত মুর্শিদাবাদের ফারাক্কা অংশের কাজ নিয়ে। তাঁরা আদালতের কাছে কাজ বন্ধ রাখার আবেদন করেছেন।
এপিডিআরের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘তবে আমাদের আবেদনে প্রকল্প নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন করা হয়েছে। পুরো প্রকল্পের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন নিয়েই উত্তর দিতে হবে।’
ফারাক্কার বেনিয়াগ্রাম ও ইমামনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দারা ২০২২ সালের জুলাইয়ে আদানির প্রকল্প নিয়ে বিক্ষোভ দেখান, তাঁরা আদানির প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেন। বিক্ষোভকারীরা তখন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, বিষয়টি নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি, ফলে তাঁরা কাজ করতে দেবেন না। বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যুব কংগ্রেসের স্থানীয় নেতা আসিফ ইকবাল।
আসিফ ইকবাল বলেছিলেন, বিদ্যুতের তার বসতবাড়ির ওপর দিয়ে যাওয়ার কারণে সেখানে ভবিষ্যতে দোতলা বাড়ি নির্মাণ করা যাবে না, ফলে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। গ্রামবাসীর বক্তব্য ছিল, আদানি গোষ্ঠী শুধু যেখানে তাদের টাওয়ার বসাচ্ছে, সেখানেই ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। কিন্তু চাষের জমির ওপর দিয়ে বিদ্যুৎবাহী তার গেলে, সে জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে না।
রঞ্জিত শুর বলেন, ওই ঘটনার জেরে ফারাক্কায় বিদ্যুতের লাইন বসানোর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তবে দুই সপ্তাহ আগেও সংস্থার কর্মীরা অতীতে চিহ্নিত করা কিছু গাছ কাটতে এসেছিলেন। গ্রামবাসীর প্রতিরোধের মুখে তাঁরা চলে যান। তবে জুলাইয়ের আন্দোলনের পর ব্যাপক পুলিশি পাহারায় চার দিন টানা কাজ করে মূল কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছে আদানি গোষ্ঠী।
রঞ্জিত শুর অভিযোগ করেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে কোনো চুক্তি ছাড়াই চাষিদের সম্মতি না নিয়ে, অর্থ ছড়িয়ে গায়ের জোরে হাইটেনশন লাইন টানা হয়েছে, টাওয়ার বসানো হয়েছে। প্রতিবাদী কৃষকদের পুলিশ মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছে, বেধড়ক মারধর করেছে।
প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তাজপুরে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর করার কথা আদানি গোষ্ঠীর। কয়েক বছর আগে ২০১৭ সালে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার ভাঙড়ে বিদ্যুতের ‘হাইটেনশন’ তার বসানোর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন সেখানকার কৃষক ও বাসিন্দারা। আন্দোলনে কয়েকজন মারা যান, কাজ পিছিয়ে যায়।
আদানির মামলাটি হাইকোর্টে এমন এক সময়ে হয়েছে, যখন মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ জানিয়েছে, আদানি গোষ্ঠী ‘শেয়ারবাজারে কয়েক যুগ ধরে অর্থনৈতিক কারচুপি করেছে’। তাদের এই প্রতিবেদনের ফলে শেয়ারবাজারে আদানি গোষ্ঠীর সব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম কমেছে। সংস্থার প্রধান গৌতম আদানির ব্যক্তিগত সম্পদও কমেছে।