ভারতের গণতন্ত্র নিয়ে বলতে গিয়ে বাংলাদেশ, রাশিয়া ও পাকিস্তানের প্রসঙ্গ টানলেন কেজরিওয়াল

ভারতের দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ও আম আদমি পার্টির (আপ) নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল দেশটির সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তাঁর সাক্ষাৎকারটি আজ শুক্রবার প্রকাশিত হয়েছে। সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর কারাগারে যাওয়া, ভারতের গণতন্ত্র, নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। তাঁর সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

ভারতের দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ও আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল

প্রশ্ন: আপনিই প্রথম মুখ্যমন্ত্রী, যাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এখন যেহেতু আপনি অন্তর্বর্তীকালীন জামিনে বেরিয়ে এসেছেন, আপনি সেখানকার সময় সম্পর্কে কী ভাবেন?

কেজরিওয়াল: দেশ খুব কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ধীরে, এবং এখন খুব দ্রুত, দেশ একনায়কতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা (কেন্দ্রের বিজেপি সরকার) প্রথমে (ঝাড়খন্ডের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী) হেমন্ত সোরেনকে ও পরে আমাকে গ্রেপ্তার করেছে।

আমাকে গ্রেপ্তার করে তারা দেশের মানুষকে একটা বার্তা দিচ্ছে। তা হলো তারা যদি কেজরিওয়ালকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করতে পারে, তাহলে যে কাউকেই তারা গ্রেপ্তার করতে পারে। তাই অন্যদের ভয় করা উচিত। আর তারা (বিজেপি) যা বলে, মানুষকে তা–ই করা উচিত। এগুলো একনায়কতন্ত্রের লক্ষণ।

গণতন্ত্রে তাদের (বিজেপি) মানুষের কথা শোনা উচিত। কিন্তু তারা জনগণকে তাদের কথা শুনতে বলছে। এ থেকে আমাদের দেশকে বাঁচাতে হবে। এক অর্থে, এটা স্বাধীনতাসংগ্রামের মতো। অনেক মানুষ যাঁরা আজ আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন, তাঁরা দীর্ঘ সময়ের জন্য কারাগারে ছিলেন।

আমার কারাগারে যাওয়াটা দেশ বাঁচানোর জন্য, দুর্নীতির জন্য নয়। আপ নেতা মনীশ সিসোদিয়া ভুল কিছু করেছেন বলে কারাগারে যাননি। এই দেশের স্বাধীনতার জন্য মানুষ যেমন দীর্ঘদিন কারাগারে গেছে, আমরাও গণতন্ত্র ও সংবিধান বাঁচাতে কারাগারে যাচ্ছি। আমি সব সময় বলেছি, দেশের জন্য জীবন দিতে পারি। এটি সেই সংগ্রামের একটি অংশ।

প্রশ্ন: আপনার দলের দাবি, কোনো আবগারি কেলেঙ্কারি ঘটেনি। কিন্তু আদালত (জামিনের আবেদনের শুনানিতে) এ দাবির ব্যাপারে আশ্বস্ত হননি।

কেজরিওয়াল: মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন (পিএমএলএ) পুরো ফৌজদারি আইনের দর্শনের বিপরীত। ফৌজদারি ব্যবস্থায় নিয়ম হলো একটি এফআইআর হবে। তদন্ত করা হবে। মামলা হবে। বিচারে আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন, একজন ব্যক্তি দোষী, না নির্দোষ। তারপরই কেবল দোষী ব্যক্তির শাস্তি হবে।

এখন উল্টো হচ্ছে। একটি এফআইআর করা হয়। যাঁদের সন্দেহ হয়, তাঁকে প্রথম দিনেই গ্রেপ্তার করা হয়। তারপর তদন্ত চলতে থাকে। আর গ্রেপ্তার ব্যক্তি কারাগারে থাকেন। আদালতে ব্যক্তিকে নির্দোষ ঘোষণা করলে তখনই তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। পিএমএলএ এটাই বলে। তাই কেউ জামিন পাচ্ছেন না। আর এখানে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার নেই বললে চলে। সব মামলাই ভুয়া। এই আইন আনা হয়েছিল বিরোধীদের পুরোপুরি ধ্বংস করতে, যাতে হয় লোকেরা বিজেপিতে যোগ দেয় অথবা কারাগারে যায়।

প্রশ্ন: আপনি কী কারণে এমন বলছেন যে বিজেপি আপকে, বিশেষ করে আপনাকে নিশানা করছে?

কেজরিওয়াল: আম আদমি পার্টির অভূতপূর্ব উত্থান। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যাঁদের দেখাসাক্ষাৎ আছে, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আমাদের বন্ধুও—তাঁরা আমাদের বলেন যে প্রধানমন্ত্রী ঘন ঘন আপ নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলছেন, ভবিষ্যতে আপ তাদের জাতীয়ভাবে এবং অনেক রাজ্যে চ্যালেঞ্জ করবে। তারা এটিকে কুঁড়িতে বিনষ্ট করে দিতে চায়। বড় হয়ে ওঠার আগেই তারা আপকে শেষ করে দিতে চায়।

প্রশ্ন: অন্তর্বর্তীকালীন জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর আপনি বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৭৫ বছর বয়সে অবসর নেবেন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তাঁর স্থানে আসবেন। কেন? অমিত শাহ তো ভিন্ন কথা বলছেন...

কেজরিওয়াল: অমিত শাহ এবং আরও অনেকে সেদিন এটি বলেছিলেন। তবে অবসর না নিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁদের আবেদন ছিল। মোদি বিষয়টি নিশ্চিত করেননি। তিনি যে নিয়ম তৈরি করেছিলেন, তা না মানলে লোকে বলবে, তিনি নিয়মটি করেছিলেন শুধু আদভানিকে (এল কে আদভানি) নিষ্ক্রিয় করতে। যদি মোদি বলেন আমি অবসর নেব না, এই নিয়ম আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, তাহলে আমি বিশ্বাস করব।

অন্য নেতারা অবশ্যই তা বলবেন। তিনি (মোদি) যেহেতু বলেননি, তার মানে তিনি আগামী বছর অবসর নেবেন। বিজেপির ভেতরে খুবই বাজে রকমের উত্তরাধিকার লড়াই চলছে। মোদি চান, অমিত শাহ প্রধানমন্ত্রী হোন। আর এটা বিজেপির বাকিদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রশ্ন: প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদির তৃতীয় মেয়াদ কেমন হতে পারে বলে আপনার মনে হয়?

কেজরিওয়াল: তারা সংবিধান পরিবর্তন করবে এবং দেশ স্বৈরাচারের দিকে যাবে। হয় দেশে কোনো নির্বাচন হবে না, নয়তো রাশিয়ার মতো নির্বাচন হবে, যেখানে পুতিন হয় সব বিরোধীকে কারাগারে পুরে রেখেছেন বা তাঁদের হত্যা করেছেন। এরপর নির্বাচন হয় এবং তিনি ৮৭ শতাংশ ভোট পান।

বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সবাইকে কারাগারে রেখে বিপুল ব্যবধানে জিতেছেন। পাকিস্তানে তারা (সেনাবাহিনীর দিকে ইঙ্গিত করে) ইমরান খানকে কারাগারে পুরেছে। তাঁর দল, দলীয় প্রতীক কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তারপর তারা জয়ী হয়েছে।

আমাদের দেশেও এ ধরনের নির্বাচন হবে। বিরোধীরা কারাগারে থাকবে আর তারা (ক্ষমতাসীন) ভোট পেতে থাকবে। এবারও তারা আমাকে কারাগারে ঢোকাল। মনীশ সিসোদিয়াকে কারাগারে রেখেছে। আমাদের দলের পাঁচ শীর্ষ নেতাকে কারাগারে দিল।

তারা আমাদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করতে চলেছে। তারা কংগ্রেসের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করেছে। হেমন্ত সোরেনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তারা এনসিপিকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। তাদের প্রতীক কেড়ে নিয়েছে। তারা শিবসেনাকে বিভক্ত করেছে। তাদের প্রতীক কেড়ে নিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের অনেক মন্ত্রীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। স্ট্যালিন সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গেও একই কাজ হয়েছে। আমরা কীভাবে লড়াই করছি, তা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।

প্রশ্ন: যেসব রক্ষাকবচ আছে, সেগুলোর কী অবস্থা?

কেজরিওয়াল: তারা রক্ষাকবচগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। কী কী রক্ষাকবচ ছিল? এ দেশে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ছিল। একের পর এক তারা এসব প্রতিষ্ঠান দখল করে ধ্বংস করেছে...আজ তদন্তকারী সংস্থাগুলো, নির্বাচন কমিশনের আচরণ দেখুন। বিচার বিভাগকে প্রকাশ্যে হুমকি দেওয়া হয়। তাদের নেতারা যে ধরনের বিবৃতি দেন, তাতে বিচার বিভাগ খুবই চাপে থাকে।

একে একে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান শেষ হচ্ছে...এমন কিছু ব্যক্তি থাকতে পারেন, যাঁরা এখনো শক্ত অবস্থানে আছেন। কিন্তু তারা (ক্ষমতাসীনেরা) প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রত্যেককে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।

প্রশ্ন: আপনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, আবার কারাগারে গেলে (২ জুন) দীর্ঘ সময়ের জন্য যেতে পারেন...

কেজরিওয়াল: আমাকে কত দিন কারাগারে রাখতে চান, এ প্রশ্নের উত্তর একমাত্র প্রধানমন্ত্রীই দিতে পারবেন।

প্রশ্ন: আপনাকে কারাগারে রাখার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর চাওয়ার ব্যাপার বলে আপনি মনে করেন?

কেজরিওয়াল: অবশ্যই। তাঁরাই ঠিক করেন, কাকে কত দিন কারাগারে রাখতে হবে। মনীশ সিসোদিয়া ও সত্যেন্দ্র জৈনকে বার্তা দেওয়া হয়েছে, ‘বিজেপিতে যোগ দাও, আমরা তোমাদের জামিন দেব।’

প্রশ্ন: লোকসভা নির্বাচনের ফল নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

কেজরিওয়াল: বিজেপির সম্ভাব্য পতনের তিনটি কারণ রয়েছে। এক. বেকারত্ব ও মূল্যবৃদ্ধি। মানুষ জেরবার হয়ে আছে। কাজের অভাবে বেকার যুব সম্প্রদায় ঘরে বসে রয়েছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী নির্বাক।

দুই. বিজেপি এবার দল হিসেবে লড়ছে না। বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডা আরএসএস সম্পর্কে যা বলেছেন, ওদের আর প্রয়োজন নেই। তাঁর এ কথা থেকে স্পষ্ট, আরএসএস এবার বিজেপিকে জেতাতে ময়দানে নামেনি। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ উত্তরাধিকারের লড়াই শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী চান অমিত শাহকে তুলে ধরতে। কিন্তু বিজেপির অন্যদের কাছে শাহ গ্রহণযোগ্য নন। অমিত শাহকে এগিয়ে দিতে যেভাবে ওরা বসুন্ধরা রাজে (রাজস্থানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী), শিবরাজ সিং চৌহান (মধ্যপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী) ও রামন সিংকে (ছত্তিশগড়ের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী) কোণঠাসা করেছে, তাতে সবাই ক্ষুব্ধ। এখন ওরা উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকেও সরিয়ে দিতে চাইছে। ক্ষুব্ধ তিনিও।

তিন. স্বৈরতন্ত্র। এত জায়গায় এত মানুষের মুখে আমি স্বৈরতন্ত্র (তানাশাহি) শব্দটা শুনেছি যে অবাক হয়ে ভেবেছি, বিষয়টা সাধারণ মানুষের মধ্যে গেঁথে গেছে।

এই তিন কারণে আমার বিশ্বাস, বিজেপি এবার ২২০ আসনের কম পাবে, ইন্ডিয়া জোট পাবে ৩০০ আসনের মতো।