প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত

বিজেপির সভাপতি নিয়োগ নিয়ে কি মোদির সঙ্গে আরএসএসের দূরত্ব আরও বাড়বে

রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) প্রধান মোহন ভাগবতের পর নির্বাচনী বিপর্যয় নিয়ে এবার বিজেপির সমালোচনায় মুখর হলো সংঘের মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’। সেখানে এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, বিজেপির নেতা–কর্মীরা মাটির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা উড়ছিলেন। এই ভোট তাঁদের জমিতে ফিরিয়ে এনেছে।

মোহন ভাগবত যেদিন নাম উল্লেখ না করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সমালোচনা করেন, তার এক দিন পরই গতকাল মঙ্গলবার অর্গানাইজারে বিজেপির নেতা–কর্মীদের সমালোচনা করেন সংঘের অন্যতম সদস্য রতন সারদা।

রতন এক নিবন্ধে লেখেন, এটা ঠিক যে আরএসএস কখনোই বিজেপির পদাতিক বাহিনী নয়। কিন্তু বিজেপির নেতা–কর্মীরা ভোটের কাজে সাহায্যের জন্য এবার স্বয়ং সেবকদের কাছে যাওয়ার প্রয়োজনই বোধ করেননি। তাঁরা একটা আনন্দের বলয়ের মধ্যে বাস করছিলেন। মোদিজির গৌরবে উদ্ভাসিত ছিলেন। জনতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। ভেবেছিলেন, মোদিই তরিয়ে দেবেন।

আরএসএসের এই অন্যতম সদস্য লিখেছেন, এই নির্বাচনের ফল এক অর্থে বাস্তব পরিস্থিতি। বিজেপির বহু নেতা–কর্মী আস্থায় টইটম্বুর ছিলেন। অতিমাত্রায় আস্থাশীল ছিলেন। তাঁরা বুঝতেই পারেননি যে ৪০০ পার–এর স্লোগানের লক্ষ্য ছিলেন তাঁরা। মোদি চেয়েছিলেন তাঁদের উজ্জীবিত করতে। সে জন্যই লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে দিয়েছিলেন। পাশাপাশি বিরোধীদের ভয় দেখাতেও চেয়েছিলেন। অথচ নেতা–কর্মীরা নিজেদের বলয়ে আবদ্ধ থাকলেন। মোদির ছটায় গৌরবান্বিত বোধ করতে লাগলেন।

রতন সারদা আরও অনেক কথা লিখেছেন। অনেক বিষয়ে সমালোচনা করেছেন। যেমন, অন্য দল থেকে লোক এনে প্রার্থী করা, মোট প্রার্থীদের মধ্যে যা অন্তত ২৫ শতাংশ। অযথা রাজনীতিরও সমালোচনা করেছেন তিনি। যেমন তিনি বলেছেন, মহারাষ্ট্রে অজিত পাওয়ার ও তাঁর অনুগামীদের জোটে টানার দরকারই ছিল না। বিজেপি ও শিন্ডে সেনা দিব্যি চালাচ্ছিল।

রতন লিখেছেন, অজিতদের ভেড়ানোয় বিজেপির কর্মীদের মনোবল নষ্ট হয়েছে। কারণ, তাঁরা এত বছর ধরে কংগ্রেসের আদর্শের বিরুদ্ধেই লড়াই করেছেন। অজিত পাওয়ারকে দলে টেনে বিজেপি তার ব্র্যান্ড ভ্যালু নষ্ট করেছে।

এই সংঘাত সত্ত্বেও আরএসএস এত দিন সেভাবে প্রকাশ্যে সরব হয়নি। কারণ, মানুষ মোদি–মাহাত্ম্যে বিভোর ছিল। মোদি ফল দিচ্ছিলেন, তাই তাঁরাও চুপ ছিলেন। যদিও সংঘকে উপেক্ষা করে মোদির নিজের মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি তাঁরা মেনে নিচ্ছিলেন না। অহংবোধ মানছিলেন না। কর্তৃত্ববাদী মনোভাব পছন্দ করছিলেন না।

মোদি নিজেকে প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বড় ভেবেছিলেন, নিজেকে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ মনে করছিলেন, আচার–আচরণে তার প্রতিফলন ঘটাচ্ছিলেন, সংঘের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজনও বোধ করছিলেন না। তবু সংঘ তাঁর সঙ্গে দ্বন্দ্বে যায়নি। প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেনি। এখন বাস্তবের মাটিতে যখন তিনি আছড়ে পড়েছেন, তখন সংঘও তার প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হয়েছে। এখন মনে করা হচ্ছে যে বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আরএসএস মতামত খাটানোর চেষ্টা করবে, প্রভাবিত করবে।

সেটা কতটা, তা বোঝা যাবে বিজেপির সভাপতি নির্বাচনের সময়। এটাই প্রথম পরীক্ষা। দলের সভাপতি হিসেবে জগৎ প্রতাপ (জেপি) নাড্ডার মেয়াদ ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। নির্বাচনের জন্য তা জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। নতুন সভাপতি বাছাইয়ের সময় সংঘ নিশ্চিতভাবেই চাইবে এমন একজনকে, যাঁর সঙ্গে সংঘের যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ। যিনি ভবিষ্যতে শুধু নরেন্দ্র মোদির অন্ধ অনুগামী হবেন না।

এই মুহূর্তে তিনজনের নাম বিবেচিত হচ্ছে। তিনজনই সংঘের ঘনিষ্ঠ। একজন হলেন মহারাষ্ট্রের অনগ্রসর (ওবিসি) নেতা বিনোদ তাউড়ে। বিজেপির এই সাধারণ সম্পাদক এবার বিহারের ভোটের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁকে সভাপতি করা হলে মহারাষ্ট্রে বিজেপি অবশ্যই চনমনে হবে। তবে প্রধানমন্ত্রীর মতো তিনিও ওবিসি সম্প্রদায়ভুক্ত। সরকার ও দল দুই দায়িত্বে ওবিসি নেতাকে রাখা হবে কি না, সেই বিতর্ক চলছে।

দ্বিতীয় নামটি আরেক সাধারণ সম্পাদক সুনীল বনসলের। সংঘের এই প্রচারক উত্তর প্রদেশে বিজেপির দায়িত্বে ছিলেন ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত। তারপর তাঁকে দেওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ও তেলেঙ্গানার দায়িত্ব। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া অন্যত্র তিনি সফল। তৃতীয় ব্যক্তি হচ্ছেন ওম প্রকাশ মাথুর। রাজস্থানের লোক হলেও তিনি দিল্লির রাজনীতিক। অন্য দুজনের মতো তিনিও সংঘের ঘনিষ্ঠ এবং বিজেপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো।

ভোটের ফল প্রকাশের পর মোদি অবশ্য কিছুটা কোণঠাসা। ৩০৩ থেকে ২৪০টি আসনে নেমে আসা তাঁর ব্যক্তিগত পরাজয়। কেননা, পুরো নির্বাচনে তিনিই ছিলেন শাসক জোটের একমাত্র মুখ। প্রতিটি আসনেই তিনিই ছিলেন প্রার্থী। জনসভায় নিজেই বারবার সে কথা সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। সেই অর্থে এবারের ভোট ছিল মোদির পক্ষে–বিপক্ষের গণভোট।

মোদি সরকার গঠন করলেও নিশ্চিতভাবেই জনতার সেই রায় তাঁর বিপক্ষে গেছে। সেখান থেকে নিজেকে তিনি টেনে তুলতে পারলে আবার স্বমহিমায় ফিরতে পারেন। এ বছরই সে পরীক্ষায় তাঁকে বসতে হবে। পরীক্ষা কিন্তু বেশ কঠিন।

চলতি বছর শেষ হওয়ার আগেই হতে চলেছে মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, ঝাড়খন্ড ও জম্মু–কাশ্মীর বিধানসভার ভোট। পরের বছর ভোট দিল্লিতে। এসব রাজ্যের মধ্যে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় বিজেপি ক্ষমতায়। দুই রাজ্যেই লোকসভা ভোটে বিরোধীরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে। মহারাষ্ট্রে ৪৮ আসনের মধ্যে বিরোধীরা দখল করেছে ৩০টি, হরিয়ানায় ১০টির মধ্যে ৫টি। এই দুই রাজ্যে বিজেপি হারলে মোদির ওপর চাপ আরও বাড়বে। বিরোধীরাও সরকারকে অতিষ্ঠ করে তুলবে।

ঝাড়খন্ডের আদিবাসী মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকে জেলে পোরা হয়েছে ভোটের আগে। ওই রাজ্যে আদিবাসীদের সহানুভূতি হেমন্তের দিকে। দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁর স্ত্রী কল্পনা। ঝাড়খন্ডের দিকে তাকিয়েই বিজেপি ওড়িশায় মুখ্যমন্ত্রী পদে বসিয়েছে ৫৩ বছর বয়সী আদিবাসী নেতা মোহন মাঝিকে।

জম্মু–কাশ্মীরের ভোট সেপ্টেম্বরে করার নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। তা করার আগে পরিস্থিতি বিচারে করানো হলো লোকসভার ভোট। সেই ভোট বিজেপির পক্ষে মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। জম্মু ও উধমপুরের হিন্দুপ্রধান এলাকায় জিতলেও উপত্যকার ভোট বিজেপির চিন্তা বাড়িয়েছে। বিজেপির সমর্থন ও মদদপুষ্ট আপনা পার্টি, পিপলস কনফারেন্স ও গুলাম নবি আজাদের দল আজাদ পার্টি কেউই কোনো আসন জেতেনি।

রাজ্যে দুটি আসন জিতেছে ন্যাশনাল কনফারেন্স, একটি আসনে জয়ী হয়েছেন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা বলে চিহ্নিত জেলবন্দী প্রকৌশলী রশিদ। লাদাখের আসনও বিজেপি হারিয়েছে। ভোটের পর নতুন করে সহিংসতা বেড়েছে। কাশ্মীর স্বাভাবিক বলে দাবি করে আসা মোদি সরকারের কাছে এটা বড় চ্যালেঞ্জ।

ঈশ্বরপ্রেরিত পরমাত্মার অংশ নরেন্দ্র মোদির চ্যালেঞ্জ তাই ত্রিমুখী। সংঘ পরিবার, জোট শরিক ও বিরোধী পক্ষ। এত দিন ধরে উপেক্ষিত আরএসএস নতুন করে প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট। মোদিকেও দূরত্ব ঘোচাতে প্রস্তুত হতে হবে।