এক নিশ্বাসে দুটি অভূতপূর্ব মন্তব্য করে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজনীতিতে আজ বুধবার আলোচনার জন্ম দিয়েছেন বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা বিজেপির শুভেন্দু অধিকারী। একদিকে তিনি বলেছেন, দলে সংখ্যালঘু মোর্চার প্রয়োজন নেই, যা এখনো কেন্দ্রীয় স্তরে বিজেপির ঘোষিত নীতি নয়। সংখ্যালঘু মোর্চা বলতে এখানে প্রধানত মুসলমান সমাজকে বোঝাচ্ছে। কারণ, পশ্চিমবঙ্গে ২০১১ সালের আদমশুমারি মোতাবেক মুসলমান জনসংখ্যা ২৭ শতাংশের সামান্য বেশি। রাজ্য ও জাতীয় স্তরে সংখ্যালঘু মোর্চা প্রধানত মুসলমান সমাজের জন্য তৈরি করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, শুভেন্দু অধিকারী তাঁর ভাষণে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির স্লোগান ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ (সবার সঙ্গে সবার উন্নয়ন) সম্পূর্ণ খারিজ করে দেন। এ কথা যখন তিনি বলেন, তখন মঞ্চে বিজেপির রাজ্য স্তরের বর্তমান ও সাবেক নেতারাসহ কেন্দ্রীয় স্তরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা মনোহরলাল খাট্টার উপস্থিত ছিলেন।
আজ বুধবার কলকাতায় রাজ্য বিজেপির বর্ধিত কর্মসমিতির বৈঠকে শুভেন্দু যা বলেন, তা এ রকম, ‘আমরা জিতব, হিন্দু বাঁচাব। সংবিধান বাঁচাব...আমিও বলেছি রাষ্ট্রবাদী মুসলিম। আপনারাও বলেছেন, সবকা সাথ সবকা বিকাশ। আর বলব না (হাত জোড় করে); বরং বলব, যো হামারে সাথ, হাম উনকা সাথ (যে আমাদের সঙ্গে আছে, আমরা তাদের সঙ্গে আছি)। সবকা সাথ, সবকা বিকাশ বন্ধ করো। নো নিড সংখ্যালঘু মোর্চা (সংখ্যালঘু মোর্চার প্রয়োজন নেই)। ভালো থাকুন। জয় শ্রীরাম।’
শুভেন্দু অধিকারী স্পষ্ট করে জানালেন, পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান সমাজকে কাছে টেনে তাদের ভোট পাওয়ার যে চিন্তা বিজেপি করে, তা ভিত্তিহীন। মুসলমান সম্প্রদায় কখনোই বিজেপিকে ভোট দেবে না। ফলে হিন্দু ভোটের ওপরই বিজেপিকে নির্ভর করতে হবে। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের যে ৭২ শতাংশ হিন্দু ভোট আছে, সেই ভোটকে লক্ষ্য করে ৪৫-৫০ শতাংশ ভোট টেনে নির্বাচনে জয় পেতে হবে।
তাঁর এই তত্ত্বের পক্ষে বৈঠকে সওয়ালও করেন শুভেন্দু। তিনি বলেন, মুসলমান ভোট এক জোট হয়ে পুরোপুরি তৃণমূলের দিকে চলে যাওয়ার ফলে প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েও শেষ পর্যন্ত আসন জিততে পারছে না বিজেপি। এ জন্যই মুসলমানদের কাছে টানতে গঠিত সংখ্যালঘু মোর্চার প্রয়োজন নেই বলে মন্তব্য করেন বিরোধীদলীয় নেতা।
কিন্তু এই তত্ত্ব জাতীয় স্তরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) ও বিজেপির সংখ্যালঘু মুসলমাননীতির বিরোধী। ২০০২ সালে আরএসএসের অনুমতিক্রমে তৎকালীন প্রধান কে এস সুদর্শনের নেতৃত্বে গঠিত হয় রাষ্ট্রীয় মুসলিম মঞ্চ। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়কে আরএসএস ও বিজেপির কাছে টানা। বর্তমানে সেই সংগঠনের দায়িত্বে রয়েছেন আরএসএসের অন্যতম শীর্ষ নেতা ইন্দ্রেস কুমার। এই মঞ্চের সদস্যসংখ্যাও এখন বেশ ভালোই, অর্থাৎ মুসলমানরা ধীরে ধীরে আরএসএস ও বিজেপির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন।
বিষয়টি মাথায় রেখেই কয়েক বছর ধরে প্রধানত উত্তর প্রদেশ ও বিহারে বিপুলসংখ্যক মুসলমানকে বিজেপির দিকে টানার চেষ্টা করছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মুসলমান সমাজের মধ্যে পিছিয়ে পড়া ভোটারদের কাছে টানতে উত্তর প্রদেশের পসমন্দা সমাজের মধ্যে তিনি এই নির্বাচনের আগে প্রচারও করেছেন।
কিন্তু শুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে এসব করে কোনো লাভ হচ্ছে না। মুসলমান সমাজ বিজেপির দিকে আসছে না। সরাসরি তৃণমূলকেই সাহায্য করছে। এ অবস্থায় তাঁর পরামর্শ, ‘সংখ্যালঘু মোর্চার প্রয়োজন নেই।’ বিজেপির আরও অনেকে তাঁর বক্তব্যে অবাক হয়েছেন। কারণ, তিনি প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নের সার্বিক স্লোগানকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছেন।
শুভেন্দুর এসব মন্তব্য বিজেপি ঠিক কীভাবে দেখছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে দলের সাবেক এক রাজ্য সভাপতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেন তিনি হঠাৎ এই মন্তব্য করলেন, তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। আমি দলের সঙ্গে কথা বলে পরে জানাব।’
সাবেক আরেক রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনহা বলেছেন, মন্তব্যটি দলের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে করা হয়নি। এটি শুভেন্দু অধিকারীর ব্যক্তিগত মন্তব্য।
শুভেন্দুর এই মন্তব্যের পরেই তৃণমূলের অন্যতম মুখপাত্র শান্তনু সেন বলেন, ‘একদিকে যখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, আমরা ১১ কোটি মানুষের জন্য কাজ করব এবং যাঁরা আমাদের ভোট দেয়নি তাদের জন্যও কাজ করব, তখন বিজেপি বলছে, যারা তাদের পাশে থাকবে, কেবল তাদের জন্যই তারা উন্নয়ন করতে চায়। তারা চরম হতাশাগ্রস্ত। এতে তাদের রাজনৈতিক চরিত্রই মানুষের সামনে প্রকাশ হয়ে পড়ছে।’
কংগ্রেস ও সিপিএম অভিযোগ তুলেছে, বিজেপি আবার নতুন করে বিভাজনের রাজনীতি শুরু করেছে।