ভারতের লোকসভা নির্বাচনে আগামীকাল মঙ্গলবার তৃতীয় দফায় পশ্চিমবঙ্গে হঠাৎই যেন তৃণমূলের পাল্লা ভারী হয়ে উঠেছে। এর কারণটা বোঝা যায় তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণ থেকেই।
পশ্চিমবঙ্গের সন্দেশখালীতে গ্রামের নারীদের তৃণমূলের স্থানীয় নেতারা ধর্ষণ করেছিলেন বলে যে অভিযোগ বিজেপি মাসখানেক আগে করেছিল, সেই অভিযোগ খণ্ডন করে একটি গোপন ক্যামেরায় তোলা ভিডিও সামনে এসেছে। এই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, সন্দেশখালীতে বিজেপির এক স্থানীয় নেতা বলছেন যে পুরো ঘটনাটাই সাজানো। এর পেছনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বিধানসভার নেতা শুভেন্দু অধিকারীর হাত রয়েছে বলেও জানান বিজেপির ওই নেতা। এই অভিযোগ অবশ্য বিজেপি অস্বীকার করেছে এবং শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন যে ওই গোপন ক্যামেরায় তোলা ভিডিওটি ভুয়া।
এই ঘটনা ছাড়াও কলকাতার রাজভবনে রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের বিরুদ্ধে এক নারী কর্মীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছে। এই দুই অভিযোগ কাজে লাগিয়ে বিজেপিকে রাতারাতি রক্ষণাত্মক করে দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। মমতা এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এই দুটি বিষয় নিয়ে প্রবলভাবে আক্রমণ করেছেন বিজেপিকে, রাজ্য বিজেপির পাশাপাশি জড়িয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও। এই ঘটনায় বিজেপি যে হঠাৎই চাপে পড়ে গেছে, তা স্বীকারও করছেন রাজ্যের বিজেপি নেতারাও।
সোমবার নির্বাচনের এক দিন আগে অন্য জেলায় ভাষণ দিতে গিয়ে তৃণমূলের অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘একটা রাজনৈতিক দল যে এতটা নীচু হতে পারে, এতটা নির্লজ্জ হতে পারে, সেটা আমরা কল্পনাও করিনি।...আমরা দেখেছি, বিজেপি ভোট পাওয়ার জন্য দুই হাজার টাকার বিনিময়ে মা-বোনদের সম্মান বিক্রি করেছে। বিজেপি সারা দেশে সমগ্র বাংলাকে অপমান করেছে, উপহাস করেছে।’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এদিন তাঁর ভাষণে জোর দিয়েছেন সন্দেশখালীর ভিডিওর ওপর। তিনি বলেন, ‘সন্দেশখালীতে কীভাবে পরিকল্পনা করে মেয়েদের অসম্মান করেছে, দেখেছেন তো? ওরা জানে না, মেয়েদের কাছে টাকাটা বড় কথা নয়। তাঁদের কাছে আত্মসম্মান, মেয়েদের সম্মান অনেক বড়। নির্বাচনে জিততে একটা পরিকল্পনা তৈরি করেছে। চক্রান্ত করেছে, একদিন এই চক্রান্ত ফাঁস হবেই।’ পাশাপাশি, সংশোধিত নাগরিকত্ব নিয়ে নিয়মিতভাবেই কথা বলছেন মমতা।
এই দুই বিষয় সামনে এনে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে একেবারে পাড়ার স্তরে স্থানীয় নেতারাও রাতারাতি বলতে শুরু করেছেন, বিজেপি নারীদের এবং বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে নারীদের চূড়ান্ত অসম্মান করেছে। পশ্চিমবঙ্গের নারী ভোটারের সংখ্যা যদি দেখা যায়, তাহলে বোঝা যাবে কেন তৃণমূল সন্দেশখালীর ভিডিও এবং রাজ্যপালের বিষয়টিকে ইস্যু করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুসারে, এবারে রাজ্যে ৩ দশমিক ৭৩ কোটি ভোটার নারী আর পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ৩ দশমিক ৮৫ কোটি। শুধু তা-ই নয়, গত পাঁচ বছরে নারী ভোটারদের নিবন্ধন উল্লেখযোগ্য (৯ দশমিক ৪ শতাংশ) হারে বেড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালেও ব্যাপক হারে পশ্চিমবঙ্গের নারীরা ভোট দিয়েছেন। ৪২ লোকসভা আসনের মধ্যে ১৭টিতে নারী ভোটার বেশি ভোট দিয়েছিলেন; অর্থাৎ শুধু নারী ভোটারদের ভোট পেয়েই প্রায় অর্ধেক আসনে প্রার্থীরা হয়তো জিতে যেতে পারেন। বিষয়টা মাথায় রেখেই তৃণমূল নির্বাচনের মাঝামাঝি নারী সম্মানের বিষয়টিকে প্রধান ইস্যু হিসেবে সামনে নিয়ে এসেছে। পরপর দুটি ঘটনা ঘটে যাওয়ায় কাজটি করতে তাদের সুবিধা হয়েছে।
অন্যদিকে বিজেপির নেতারা তৃণমূলের এই অভিযোগ এবং তাঁদেরই স্থানীয় নেতা গঙ্গাধর কয়ালের বক্তব্যে কিছুটা যে চাপের মধ্যে রয়েছেন, তা তাঁদের কথাবার্তা থেকে বেরিয়ে আসছে। বিজেপির এক প্রার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের পরিকল্পনা কী হওয়া উচিত এবং কীভাবে দুটি পৃথক ঘটনার বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়া উচিত, সেটা সব প্রার্থীর কাছে হয়তো স্পষ্ট নয়।’
বিধানসভায় দলের প্রধান শুভেন্দু অধিকারী অবশ্য ওই ভিডিওকে ‘ডিপ ফেক’ বলেছেন। নাম না করে নির্বাচনে পরামর্শদাতা সংস্থা আইপ্যাকের কথাও উল্লেখ করেছেন শুভেন্দু অধিকারী। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখ না করে তিনি জানিয়েছেন, এই পরামর্শদাতা গোষ্ঠী এবং অভিষেক যৌথভাবে এ কাজ করেছেন।