ভারতের লোকসভা নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোট শাসক দল বিজেপিকে বিশেষ উৎসাহিত করতে পারেনি। এর একটা কারণ যদি হয় গতবারের তুলনায় ভোটের হার কমে যাওয়া, দ্বিতীয় কারণ ভোটদাতাদের মধ্যে উৎসাহের অভাব। আরেকটি কারণ হতে পারে অত্যধিক গরম। বিজেপির তাত্ত্বিক নেতাদের একাংশের ধারণা, এই প্রবণতা বদল না হলে গতবারের তুলনায় এবার আসন বৃদ্ধি কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
২০১৯ সালের ভোটে বিজেপি পেয়েছিল ৩০৩ আসন, এনডিএ জোট ৩৫৩। এবার আসন জয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্বয়ং। বিজেপি ৩৭০ (সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদের দরুন), জোট ৪০০-এর বেশি আসন।
গত শুক্রবার প্রথম পর্বের ভোটের হার বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ছিল ৬০ শতাংশ। গভীর রাতে নির্বাচন কমিশন জানায়, সেটা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৬৩ শতাংশ। পাঁচ বছর আগের তুলনায় এই হার প্রায় ৩ শতাংশ কম। যে সাত দফা ভোট হবে, তাতে প্রথম ধাপের ভোটে সবচেয়ে বেশি ১০২ আসনে ভোট হয়েছে। এসব আসনের মধ্যে তামিলনাড়ু ও পদুচেরিতেই ছিল ৪০টি। যেখানে গতবার বিজেপি একটি আসনও জেতেনি। এবার ওই রাজ্যে বিজেপির ভোট বাড়লেও কোনো আসনের জয়ের সম্ভাবনা বিশেষ নেই বলে খোদ বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব বলছে।
রাজস্থান রাজ্যের ২৫ আসনেই গতবার বিজেপি জিতেছিল। শুক্রবার ১২ আসনে ভোট হয়েছে। দলের অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন—এসব আসনের মধ্যে ৮টিতে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সঙ্গে বিজেপির জোর টক্কর হয়েছে। এসব আসনের মধ্যে ইন্ডিয়া জোটের সিপিএম (সিকার), ভারতীয় আদিবাসী পার্টি (বাঁসওয়াড়া) ও রাষ্ট্রীয় লোকতান্ত্রিক পার্টিকে (নাগৌর) কংগ্রেস তিনটি আসন ছেড়েছে।
শুক্রবার অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপের ভোটের পর বিজেপির অন্দরমহলের খবর, এবার শতভাগ আসনে জয়ের আশা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। এর একটি কারণ রাজপুত সমাজের তীব্র অসন্তোষ। অন্য কারণ সেনাবাহিনীর ‘অগ্নিবীর’ (চার বছরের জন্য জওয়ানের চাকরি) প্রকল্প। রাজস্থান, উত্তরাখন্ড, হরিয়ানা, পাঞ্জাব ও পশ্চিম উত্তর প্রদেশে অগ্নিবীর প্রকল্প নিয়ে বিজেপিকে ব্যাপক জবাবদিহি করতে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংকে বলতে হয়েছে, প্রয়োজনে তাঁরা ওই প্রকল্প নিয়ে নতুন করে ভাববেন।
এই অসন্তোষের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কৃষক আন্দোলন। এ কারণে পশ্চিম উত্তর প্রদেশের আটটি আসন নিয়ে বিজেপি খুব নিশ্চিত হতে পারছে না। শুক্রবার ভোট হওয়া এই আট আসনের তিনটি গতবার এই দল জিতেছিল। এবার প্রতিটি আসনে জিততে তারা রাষ্ট্রীয় লোকদলকে কাছে টেনেছে। কিন্তু ভোটে মানুষের অনুৎসাহ দেখে বিজেপি চিন্তিত।
বিজেপির এক নেতা বলছেন, গরম অবশ্যই একটি কারণ। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আগামী দিনে এই গরমের মাত্রা আরও বাড়বে। মে মাসজুড়ে যখন ভোট হবে, আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী পারদের মাত্রা তখন ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ঘোরাফেরা করবে।
প্রথম দফার ভোটের গতিপ্রকৃতি বিজেপিকে চিন্তায় ফেলেছে অন্য কারণেও। তাদের প্রচার পুরোপুরি নরেন্দ্র মোদিনির্ভর। সব জায়গায় প্রার্থীরা মোদিকেই চাইছেন। দেশের প্রায় সব বড় বড় গণমাধ্যমে মোদি যেভাবে প্রচার পাচ্ছেন, বিরোধীরা তার ধারেকাছেও নেই। কিন্তু এত করেও ভোটের হাওয়া তোলা যায়নি। গতবারের নির্বাচনী প্রচারে মোদি বড় করে তুলে ধরেছিলেন পুলওয়ামা, বালাকোট, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। সেটা যে আলোড়ন তুলেছিল, এবারের প্রচারে রামমন্দির তা পারছে না।
প্রধানমন্ত্রী মোদি তাঁর প্রতিটি প্রচারে বিরোধীদের দুর্নীতি, পরিবারবাদ, মুসলমানদের তুষ্টিকরণের বিরোধিতার পাশাপাশি তুলে ধরছেন ২০৪৭ সালের বিকশিত ভারতের ‘উজ্জ্বল’ ছবি, যার মধ্য দিয়ে তাঁর ‘বিশ্বগুরু’ হয়ে ওঠার গৌরবও প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু বিজেপির প্রচারে এখনো বেকারত্ব ও মূল্যবৃদ্ধির কোনো উত্তর নেই। বিরোধীরা এগুলোকেই বড় করে তুলে ধরছে।
বিপুল জয় নিয়ে বিজেপির সংশয় ধরা পড়েছে অন্য আরেকটি ঘটনায়। সম্প্রতি নির্বাচনী সমীক্ষায় সবচেয়ে বেশি সুনাম অর্জন করেছেন ‘অ্যাক্সিস মাই ইন্ডিয়া’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ভোটবিশেষজ্ঞ প্রদীপ গুপ্তা। একের পর এক ভোটের সম্ভাব্য ফল তিনি তাঁর সমীক্ষায় মিলিয়ে দিয়েছেন। কর্ণাটক ও তেলেঙ্গানায় কংগ্রেসের নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতার ঘোষণা যেমন তিনি করেছিলেন, তেমনই মিলিয়ে দিয়েছিলেন মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে বিজেপির বিপুল জয়। ক্রিকেটের পরিভাষায় তাঁর ‘স্ট্রাইক রেট’ ৯৫ শতাংশের বেশি।
এক্স হ্যান্ডলে এই প্রদীপ গুপ্তার সাম্প্রতিক একটি পোস্ট শাসক দল বিজেপি নাকি মুছে দিতে বাধ্য করেছে। তিনি অবশ্য এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি এই দাবিও করেননি, এবার নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি কোনো জনমত সমীক্ষা করেছিলেন।
এক্সের সেই পোস্টে প্রদীপ বলেছিলেন, ১৩টি রাজ্য বিজেপিকে চিন্তায় রাখবে। ৪০০ আসন পেতে হলে ওই রাজ্যগুলোয় বিজেপির খারাপ ফল করা তো চলবেই না, বরং আরও ভালো করতে হবে। এসব রাজ্য হচ্ছে মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, কর্ণাটক, গুজরাট, রাজস্থান, ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়, হরিয়ানা, দিল্লি, উত্তরাখন্ড, হিমাচল প্রদেশ, গোয়া এবং কয়েকটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। ২০১৯ সালে এসব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ২৫৭টি আসনের মধ্যে বিজেপি ২৩৮টিতে জয়ী হয়েছিল।
ভারতীয় গণমাধ্যম ‘মানিকন্ট্রোল’কে দেওয়া ব্যাখ্যায় প্রদীপ গুপ্তা বলেছিলেন, ওই ১৩ রাজ্যে গতবারের ভোটে বিজেপির স্ট্রাইক রেট ছিল ৯৩ শতাংশ। এবার তা বজায় রাখা ও ওই সব আসন ধরে রাখা অসম্ভব; বরং আসন কমবে। তাঁর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, মহারাষ্ট্র, বিহার, কর্ণাটক ও দিল্লির রাজনৈতিক গতিশীলতায় অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে।
নিরপেক্ষ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, এবার এখনো পুলওয়ামার মতো কোনো বিষয় নেই। সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে এখনো কোনো হাওয়া দেখা যাচ্ছে না। জনমন প্লাবিত হতে পারে, এমন কোনো ইস্যুও এখনো দৃশ্যমান নয়। নরেন্দ্র মোদির ‘দৃঢ় নেতৃত্ব’ ছাড়া সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিজেপি ও এনডিএ নতুন কিছু তুলে ধরতে পারেনি। সেই কারণে প্রথম দফায় ভোটারদের মধ্যে উৎসাহের অভাব দেখা গেছে। প্রথম দফার ভোটের পর বিজেপি কিছুটা হলেও তাই চিন্তিত।