রাজীব গান্ধী
রাজীব গান্ধী

ফিরে দেখা

রাজীব গান্ধীর ওপর আত্মঘাতী হামলার আগের রাতে সিনেমা দেখেন খুনিরা

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা রাজীব গান্ধী ১৯৯১ সালের ২১ মে তামিলনাডু রাজ্যে নির্বাচনী প্রচার চালাতে গিয়ে আত্মঘাতী বোমায় নিহত হন। ওই মামলায় দোষী সাব্যস্ত সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছে তাঁর পরিবার। হত্যাকারীদের কেউ কেউ মারা গেছেন। বাকিরা এরই মধ্যে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। আমাদের বিশেষ আয়োজনে আজ থাকছে ভারতের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত

পাঞ্জাবের খালিস্তানপন্থী আন্দোলন দমনে কঠোর ছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। এ নিয়ে তাঁর ওপর শিখ সম্প্রদায়ের ক্ষোভ ছিল। সর্বশেষ ১৯৮৪ সালের অক্টোবরে খালিস্তানপন্থী আন্দোলনকারীদের নেতাসহ তাঁর অনুসারীদের ধরতে শিখদের পবিত্র স্থান গোল্ডেন টেম্পলে সামরিক অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর এই সিদ্ধান্তের পর শিখ সম্প্রদায়ের ক্ষোভের মাত্রা এতটাই তীব্র ছিল যে খোদ তাঁর দুই দেহরক্ষী খুব কাছ থেকে তাঁকে গুলি করে হত্যা করেন।

মা ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর মাত্র সাত বছর পর একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছিল ছেলে রাজীব গান্ধীকে। প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কায় শান্তি ফেরাতে তামিল টাইগার বিদ্রোহী ও সরকারের মধ্যে মধ্যস্থতার ভূমিকা নিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এ জন্য শ্রীলঙ্কার তামিল অধ্যুষিত অঞ্চলে ১৯৮৭ সালে ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী (আইপিকেএফ) পাঠিয়েছিল তাঁর সরকার। কিন্তু তাঁর এই পদক্ষেপকে ভালোভাবে নেয়নি তামিলরা। ১৯৯১ সালের ২১ মে তামিলনাডু রাজ্যের চেন্নাইয়ে (তৎকালীন মাদ্রাজ) নির্বাচনী প্রচার চালাতে গিয়ে তামিলদের আত্মঘাতী বোমায় প্রাণ দিতে হয়েছিল তাঁকে।

রাজীব গান্ধী নিহত হওয়ার সাত বছর পর ১৯৯৮ সালে ভারতের একটি টাডা আদালত হত্যা মামলায় ২৬ আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন। পরে সুপ্রিম কোর্ট মাত্র চারজনকে মৃত্যুদণ্ড ও বাকি তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন। অন্যদের খালাস দেওয়া হয়। মানবিক দিক বিচার করে পরে ২০০০ সালে নলিনী শ্রীহরনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। পরে ২০১৪ সালে বাকি তিনজনের মৃত্যুদণ্ডাদেশও বাতিল করা হয়। তাদেরও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

২০২২ সালের ১১ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট দণ্ডপ্রাপ্ত সাতজনকে মুক্তির আদেশ দিয়ে তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ এনে দিয়েছিলেন। প্রায় ৩৩ বছর পর নলিনী, জয়কুমার ও পেরারিভালান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ভারতে পরিবারের সঙ্গে বসবাস শুরু করেন। শ্রীলঙ্কার নাগরিক হওয়ার কারণে বাকি চারজনকে তিরুচির বিশেষ কারাগারে রাখা হয়। চারজনের মধ্যে শুধু সানথান শ্রীলঙ্কায় ফিরে যেতে রাজি হয়েছিলেন। অবশ্য পরে তিনি অসুস্থ হয়ে বিশেষ কারাগারে মারা যান।

চলতি বছরের এপ্রিলে বাকি তিনজন মুরুগান, রবার্ট পায়াস ও জয়কুমার কারাগার থেকে মুক্তি পান। তাঁরা শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো হয়ে নিজেদের শহর জাফনায় ফিরে গেছেন।

সমাবেশে বক্তৃতা করছিলেন রাজীব গান্ধী

পাইলট থেকে প্রধানমন্ত্রী

ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়েস প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন রাজীব গান্ধী। ওই সময়ে বিশ্বেও তিনি বোধ করি সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর মা ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ৪৮ বছর বয়সে। আর তাঁর নানা জওহরলাল নেহরু যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৮ বছর।

১৯৪৪ সালের ২০ আগস্ট বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) জন্ম নেন রাজীব গান্ধী। তাঁর যখন জন্ম হয়, তার তিন বছর পর স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রের জন্ম। তাঁর নানা জওহরলাল নেহরু প্রধানমন্ত্রী হলে তাঁর পরিবার লক্ষ্ণৌ থেকে দিল্লি চলে আসে। প্রায় কাছাকাছি সময়ে তাঁর বাবা ফিরোজ গান্ধী পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন।

রাজীব গান্ধীকে প্রথমে উত্তরাখন্ডের দেরাদুনের ওয়েলহাম প্রেপ স্কুলে ভর্তি করা হয়। অবশ্য কিছুদিন পর তিনি ও তাঁর ভাই সঞ্জয়কে সেখানেই ধুন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। স্কুলজীবন শেষে তিনি যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে এবং কিছুদিন পরে ইম্পেরিয়াল কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি যন্ত্রকৌশলে পড়াশোনা করেন।

রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম হলেও ভারতের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর রাজনীতির প্রতি খুব একটা আগ্রহ ছিল না। তাঁর সহপাঠীদের তথ্য অনুযায়ী, তাঁর থাকার ঘরের কক্ষটি বিজ্ঞান আর প্রকৌশলের বইয়ে ঠাসা ছিল। দর্শন, রাজনীতি বা ইতিহাসের বই ছিল না বললেই চলে। তবে সংগীতের প্রতি তাঁর বিশেষ টান ছিল। আলোকচিত্র আর অ্যামেচার রেডিওর প্রতিও তাঁর আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো।

আকাশে ওড়ার ব্যাপারে রাজীব গান্ধীর বিশেষ আগ্রহ ছিল। যুক্তরাজ্য থেকে পড়ালেখা শেষে দেশে ফিরেই তিনি বাণিজ্যিক পাইলটের লাইসেন্স নেন। পরে ভারতের রাষ্ট্রীয় উড়োজাহাজ প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসে পাইলট হিসেবে চাকরি নেন।

কেমব্রিজে পড়াশোনার সময় রাজীবের পরিচয় হয় ইতালি বংশোদ্ভূত সোনিয়া ম্যাইনোরের সঙ্গে। তিনি পড়তেন ইংরেজিতে। পরে ১৯৬৮ সালে তাঁরা দিল্লিতে বিয়ে করেন। দুই সন্তান রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে নিয়ে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনে থাকতেন। সেখানে রাজনীতির মানুষের ব্যাপক আনাগোনা থাকলেও তিনি থাকতেন নিজের মতো। সেই বাসার গমগমে রাজনীতি তাঁকে একটুও আলোড়িত করেনি।

ভাই সঞ্জয় গান্ধী বেঁচে থাকতে কখনো রাজনীতির ধারেকাছে আসেননি রাজীব। ১৯৮০ সালের ২৩ জুন বিমান দুর্ঘটনায় ভাই নিহত হলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। মা ইন্দিরা গান্ধী এবং নানামুখী চাপে তাঁকে মনোভাব পাল্টাতে হয়। ভাই সঞ্জয়ের মৃত্যুর পর ১৯৮১ সালের জুনে উত্তর প্রদেশের আমেথি থেকে উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে লোকসভায় আসেন। একই সময়ে তিনি কংগ্রেসের যুব সংগঠন ইন্ডিয়ান যুব কংগ্রেসের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হন।

সঞ্জয় গান্ধী রাজনৈতিকভাবে ‘নির্দয়’ ও ‘স্বেচ্ছাচারী’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বলা হয়ে থাকে ভারতে ১৯৭৫ থেকে ’৭৭ পর্যন্ত ইন্দিরার জরুরি অবস্থা জারির পেছনে তাঁর হাত ছিল। সেই তুলনায় রাজীব ছিলেন বেশ উদার। তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দলের নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। কোনো কিছুতে তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নিতেন না।

ভারতের ইতিহাসে ভয়াবহ এক বিয়োগান্ত ঘটনা, একই সঙ্গে তাঁকে কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়ে এসেছিল। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর দুই দেহরক্ষীর গুলিতে ইন্দিরা গান্ধী নিহত হন। মায়ের মরদেহ রেখে ওই দিনই তাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে শপথ নিতে হয়েছিল। পরে ওই বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত লোকসভা ভোটে তাঁর দল কংগ্রেস বিপুল জয় পায়। ভারতের ইতিহাসে একক দল হিসেবে ৫০৮ আসনের মধ্যে ৪০১ আসনে জয়ী হয়ে রেকর্ড গড়ে।

মায়ের মতো রাজীবও পাঞ্জাব ও কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে নিরুৎসাহিত করেন। তবে এসব ঠিকমতো সামলে নিতে পারেননি। এরই মধ্যে নানা আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে তাঁর নেতৃত্ব অকার্যকর হয়ে ওঠে। ফলে ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে তিনি পদত্যাগ করেন। ওই বছর অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে তাঁর দল পরাজিত হয়। তিনি হন লোকসভার বিরোধীদলীয় নেতা।

তবে ভিপি সিংয়ের নেতৃত্বাধীন সেই জোট সরকার বেশি দিন স্থিতিশীল হতে পারেনি। ১৯৯১ সালে সেই সরকার ভেঙে দেওয়া হয়। আবার ক্লান্তিহীন নির্বাচনী প্রচারে নামেন রাজীব গান্ধী। তামিলনাডু রাজ্যে প্রচারে গিয়ে আত্মঘাতী বোমায় তিনিসহ ১৬ জন নিহত হন।

রাজীবকে হত্যার ছক

রাজীব গান্ধী ১৯৮৭ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট জুনিয়াস রিচার্ড জয়াবর্ধনের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিলেন। ওই চুক্তির আওতায় শ্রীলঙ্কায় আইপিকেএফ মোতায়েন করা হয়েছিল। আইপিকেএফ মোতায়েনের পরই পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। লিবারেশন টাইগারস অব তামিল ইলমের (এলটিটিই) বিদ্রোহীদের সঙ্গে তাদের বিভিন্ন সময় লড়াই হতে থাকে। এতে ভারতের কয়েক হাজার সেনাও নিহত হয়েছিলেন।

রাজীব গান্ধী ক্ষমতায় এলে শ্রীলঙ্কার জাফনায় আইপিকেএফ মোতায়েন করতে পারেন এমন একটা ধারণা ছিল লিবারেশন টাইগারস অব তামিল ইলমের (এলটিটিই) নেতা ভিলুপিল্লাই প্রভাকরণের। তাই ১৯৯০ সালের অক্টোবরে জাফনার জঙ্গলে এক বৈঠকে তিনি রাজীব গান্ধীকে হত্যার নির্দেশ দেন।

জাফনা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার না করলে তৎকালীন ভি পি সিংয়ের সংখ্যালঘু সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের হুমকি দিয়েছিল বিজেপি। সরকার টেকানোর স্বার্থে তিনি ওই সময় শ্রীলঙ্কা থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করেন। এরপর নানা সংকটে ভিপি সিংয়ের সরকারের পতন হলে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আবার রাজীব গান্ধীর ক্ষমতায় আসার ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল।

১৯৯১ সালে আদালতে পুলিশের সঙ্গে নলিনী

১৯৯০ সালের অক্টোবর থেকে প্রভাকরণ তাঁর খুবই ঘনিষ্ঠ বেবি সুব্রামেনিয়াম, মুরুগান, মুথুরাজা ও শিবারাসনকে নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করতে থাকেন। সব মিলিয়ে ‘এক চোখা জ্যাক’ হিসেবে পরিচিত শিবারাসনকে রাজীব গান্ধী হত্যার মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়। তামিলনাডুর এম করুণানিধির নেতৃত্বাধীন ডিএমকে সরকার এলটিটিইর প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল ছিল। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জাফনা আর তামিলনাডুতে বসে রাজীব গান্ধী হত্যার ছক ঠিক করেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা।

মুথুরাজা আর সুব্রামেনিয়াম প্রথমে মাদ্রাজে (বর্তমান চেন্নাই) দলে ভেড়ান তামিলনাডুর দল দ্রাবিড় কাজাগাম (ডিকে) কর্মী ভাগ্যনাথনকে। তাঁর সুবাদে দলে আসেন তাঁর বোন নলিনী। এভাবে মাদ্রাজে একে একে তাঁদের দলে আলোকচিত্রী হরিবাবু, রবি শংকরন, পিয়াস, জয়কুমারন আরিভুসহ অনেকে যুক্ত হন।

সবকিছু চূড়ান্ত হওয়ার পর এলটিটিইর সদস্য ধানু ওরফে গায়ত্রী ও শুভা ওরফে শালিনিকে আত্মঘাতী হামলার জন্য বেছে নেন শিবারসারন। ঘটনাচক্রে দুজনই তাঁর আত্মীয়। তাঁদের জাফনা থেকে মাদ্রাজ এনে নলিনীর বাসায় রাখা হয়। এরপর তাঁদের আত্মঘাতী হামলা চালানোর জন্য কোমরে বোমা বেঁধে রাখতে বেল্ট বানানো হয়। ২১ মে মূল হামলা চালানোর আগে ১৮ এপ্রিল মাদ্রাজের মেরিনা সৈকতে জয়ললিতার সভা এবং ১২ মে থিরুভাল্লুরে ভিপি সিং ও করুণানিধির সভায় দুবার আত্মঘাতী হামলার মহড়া চালানো হয়। জয়ললিতার সমাবেশে আত্মাঘাতী হামলাকারীরা মঞ্চের খুব কাছে যেতে পারেননি। তবে ভিপি সিংয়ের সভায় তাঁরা সফল হন। হরিবাবু ফটোসাংবাদিক হিসেবে মঞ্চের খুব কাছে চলে যান। সঙ্গে আত্মঘাতী হামলাকারীদের নিয়ে যেতেও সক্ষম হন।

সফল দুই আত্মঘাতী মহড়ার পর আসে চূড়ান্ত সময়। ২১ মে মাদ্রাজের কাছে শ্রীপেরুমবুদুরে আসছেন এলটিটিইর আসল টার্গেট রাজীব গান্ধী। হামলার আগের দিন ষড়যন্ত্রকারীরা ছিলেন খুব খোশমেজাজে। বিশেষ করে আত্মঘাতী স্কোয়াডের অন্যতম সদস্য ধানু ছিলেন একেবারে স্বাভাবিক। রাতে সবাই মিলে সিনেমা দেখেন। ২১ মে বিকেল চারটায় নলিনী, ধানু, শুভা ও শিবাসারন আর হরিবাবু কংগ্রেস নেতা রাজীব গান্ধীর সমাবেশের উদ্দেশে রওনা দেন। তার আগে হরিবাবুর কাজ ছিল ফুলের মালা কেনা।

শ্রীপেরুমবুদুরে পাঁচজন গিয়ে মঞ্চের কাছাকাছি অবস্থান নেন। একপর্যায়ে সেখানে আনসুয়া কুমার নামে পুলিশের নারী উপপরিদর্শক তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। হরিবাবু নিজেকে ফটোসাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ধানুকে দেখিয়ে বলেন, তিনি রাজীব গান্ধীর গলায় মালা দেবেন। সেই ছবি তুলবেন তিনি। শুভা আর নলিনী ভিড়ের মধ্যে অবস্থান। শিবাসারন মঞ্চের একেবারে কাছে অবস্থান নেন। তাঁর কাছে পিস্তল ছিল। আত্মঘাতী হামলা ব্যর্থ হলে তিনি গুলি চালাবেন। ধানু আর হরিবাবু অবস্থান নিলেন লালগালিচার পাশে। এই পথ দিয়ে মঞ্চে যাবেন রাজীব গান্ধী।

রাত ১০টার দিকে রাজীব গান্ধী অনুষ্ঠানস্থলে আসেন। এ সময় মানুষ তাঁর গলায় মালা দিতে ভিড় শুরু করেন। পুলিশ কর্মকর্তা আনসুয়া আবার ধানুকে বাধা দেন, যেন রাজীবের কাছাকাছি যেতে না পারেন। কিন্তু রাজীব গান্ধী তাঁকে বলেন, সবাইকে সুযোগ দিন। এরপর আনসুয়া সরে যান। এতে অবশ্য শেষ পর্যন্ত তিনি প্রাণে বেঁচে যান। ধানু ঝুঁকে রাজীবের পা স্পর্শ করার ভান করেন। এ সময় রাজীব গান্ধী তাঁকে তুলতে যান। এরই মধ্যে ধানু ডান হাতে থাকা বোমার সুইচে চাপ দেন।

একটি সমাবেশে রাজীব গান্ধী

বিস্ফোরণের পরপরই শুভা আর নলিনী বাসস্ট্যান্ডের দিকে চলে যান। সেখানে তাঁরা শিবারাসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তিনি দুজনকে জানান, রাজীব, ধানু আর হরিবাবু নিহত। সেখান থেকে অটোরিকশা নিয়ে তাঁরা চলে যান। নলিনী আর মুরুগান জাফনায় পালিয়ে যেতে মাদ্রাজ থেকে রওনা দিয়েছিলেন। কিন্তু কঠোর নিরাপত্তা থাকায় তাঁরা সীমান্ত পাড়ি দিতে পারেননি। ব্যর্থ হয়ে তাঁরা আবার মাদ্রাজে ফিরে আসেন। সেখানেই তাঁরা ধরা পড়লে এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত হয়ে যায়। তাঁদের তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয়, আরিভু, পিয়াসহ অন্যদের। তাঁদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে জানা যায়, পুরো ঘটনার পেছনে ছিলেন এলটিটিই নেতা ভিলুপিল্লাই প্রভাকরণ।

প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ কর্মকর্তার জবানিতে সেদিন

বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা প্রতীপ ভি ফিলিপ ওই সময় তামিলনাডুর কানচিপুরামের সহকারী পুলিশ সুপার ছিলেন। চেন্নাইয়ের কাছে শ্রীপেরুমবুদুর ছিল তাঁর জেলার সীমান্তবর্তী থানা। সেই রাতের দুঃসহ ঘটনা সম্পর্কে চেন্নাইয়ের আদালতে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন ফিলিপ।

ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ওই সময় জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) ছিলেন মোহাম্মদ ইকবাল। তাঁর নির্দেশে ওই দিন আমি অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছিলাম। রাজীব গান্ধীর জনসভা একটি স্কুল থেকে সরিয়ে মহাসড়কের পাশে উন্মুক্ত স্থানে স্থানান্তরের পরিকল্পনা করছিলেন স্থানীয় কংগ্রেস নেতারা। আমরা নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথা জানালে স্থানীয় সংসদ সদস্য, কংগ্রেস নেতা মারাগাথাম চন্দ্রশেখর আমাকে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘আপনারা কি অনুষ্ঠান বাতিল করতে চান?’

চেন্নাইয়ে ১৯৯১ সালের ২১ মে সেই সমাবেশে সমর্থকদের সঙ্গে রাজীব গান্ধী। এখানেই একটু পর বিস্ফোরণে নিহত হন তিনি

মারাগাথাম জানালেন, রাজীব গান্ধী ইন্দিরা গান্ধীর মূর্তিতে পুষ্পার্পণ করবেন। সেখানে বড় সমাবেশ হবে। এর আগে এই জায়গায় কখনো রাজনৈতিক সমাবেশ হয়নি। শেষ পর্যন্ত পুলিশের আপত্তি সত্ত্বেও সেখানে সমাবেশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কংগ্রেস।

২১ মে ঘটনার দিন দুপুরে আমি ঘটনাস্থলে যাই। সেখানে আমরা মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে স্থানটি ভালোভাবে পরীক্ষা করি। অনুষ্ঠানে কারা কী করবেন, তাদের তালিকা নিই। সেখানে কোকিলা নামের একজন কবিতা আবৃত্তি করবেন। সঙ্গে সেখানে থাকবেন তাঁর মা লতা কান্নান। পরে তদন্তে এই দুজনও গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে হাজির হয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গে সন্দেহভাজন ধানু নামের সেই নারীকে দেখা গিয়েছিল।

ফিলিপ বলেন, ‘রাত ১০টার দিকে একটি অ্যাম্বাসেডর গাড়িতে করে রাজীব গান্ধী ঘটনাস্থলে আসেন। আমরা তাঁকে স্বাগত জানাই। তাঁর আসার পথ এবং সেই পথে রাখা ফুলের তোড়াসহ সবকিছু পরীক্ষা করা হয়েছে। নেমেই তিনি জনতার দিকে এগিয়ে যান। সেখানে তিনি নারীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। আমরা বলার পরও নারীরা ওই এলাকা ছাড়ছিল না।’

পুলিশ কর্মকর্তা ফিলিপ বলেন, ‘পরে রাজীব গান্ধী মঞ্চে ওঠেন। আমি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পাশে ছিলাম। পরে এসপির নির্দেশে আমি রাজীব গান্ধী থেকে কয়েক ফুট দূরত্বে সরে যাই। এরই মধ্যে কোকিলা আর তাঁর মাকে তাঁর কাছে যাওয়ার সুযোগ দিতে ইশারা দেন রাজীব গান্ধী। বাধ্য হয়ে তাঁদের দুজনসহ সেই সন্দেহভাজন খুনিকে যেতে দিতে বাধ্য হই আমরা। এরপরই সেই দুঃস্বপ্ন। রাত ১০টা ২০ মিনিটে সেকেন্ডের ব্যবধানে বিকট বিস্ফোরণ। আমি ছিটকে রাজীব গান্ধীর পায়ের কাছে গিয়ে পড়ি। আমার হাঁটু আর হাত থেকে রক্ত ঝরছিল। রাজীব গান্ধীর আশপাশে ৯ কর্মকর্তার নিথর দেহ। কোকিলা, তাঁর মা ও সেই ধানুর দেহও পড়ে আছে।’

ফিলিপ বলেন, ‘ঘটনস্থলে কোনো নিরাপত্তা কর্মকর্তা নেই। আমার চালক গাড়ি নিয়ে পালিয়েছেন। আমাকে ২৮ দিন হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিল। আমার শরীরে ১০০ স্প্লিন্টার বিঁধে ছিল। এই আতঙ্ক আমাকে বহু বছর তাড়া করেছে।’

দোষীদের ক্ষমা করে দিল রাজীব গান্ধীর পরিবার

২০০৮ সালে তামিলনাড়ুর ভেলোর কেন্দ্রীয় কারাগারে নলিনীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন রাজীব গান্ধীর মেয়ে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। ওই সময় তিনি নলিনীর কাছে বাবা রাজীব গান্ধীর হত্যা সম্পর্কে নানা কিছু জানতে চেয়েছিলেন। তখন তিনি বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছিলেন।

২০২২ সালের নভেম্বরে কারাগার থেকে মুক্তির পর খোদ নলিনী শ্রীহরন নিজেই সাংবাদিকদের বিষয়টি জানিয়েছিলেন। সে সময় নলিনী হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে যতটুকু জানতেন, তা প্রিয়াঙ্কাকে বলেছিলেন। প্রিয়াঙ্কা সে সময় কেঁদেছিলেন কি না, জানতে চাইলে নলিনী বলেছিলেন, হ্যাঁ, তিনি কেঁদেছিলেন। তিনি খুব আবেগপ্রবণ ছিলেন। বোঝা যায়, বাবার মৃত্যুর এত দিন পরও মানসিক আঘাত সারেনি প্রিয়াঙ্কার।

প্রিয়াঙ্কা একাধিকবার তামিলনাডুর কারাগারে গিয়ে তাঁর বাবার অন্যতম হত্যাকারী নলিনী ও মুরুগানের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথাবার্তা বলেছেন।

ওই সময় প্রিয়াঙ্কা তাঁর বাবার হত্যাকারীদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। শুধু তিনি নন। ভাই রাহুল গান্ধী এবং সোনিয়া গান্ধীও তাঁদের ক্ষমা করে দিয়েছেন।

রাহুল ও প্রিয়াঙ্কার মা সোনিয়া গান্ধীর হস্তক্ষেপেই আদালত তাঁর স্বামীর হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন করেছেন।

২০১৮ সালে সিঙ্গাপুরে এক সভায়ও রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, তিনি ও তাঁর বোন প্রিয়াঙ্কা তাঁদের বাবা রাজীব গান্ধীর হত্যাকারীদের ‘সম্পূর্ণভাবে ক্ষমা’ করে দিয়েছেন।

হত্যাকারীদের একজন মুরুগান (মাঝে)

শ্রীলঙ্কার বাহিনীর হাতে পরে নিহত প্রভাকরণের মৃতদেহ দেখে রাহুল গান্ধীর খারাপ লেগেছিল বলেও জানিয়েছিলেন। তাঁর কথায়, ‘প্রভাকরণের দেহটা ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে আমার দুটো জিনিস মাথায় এসেছিল। প্রথমত, এভাবে তাঁকে অপমান করা হচ্ছে কেন? দ্বিতীয়ত, তাঁর জন্য, তাঁর সন্তানদের জন্য আমার খারাপ লাগছিল।’

ওই সময় টেলিভিশনে প্রভাকরণের নিথর দেহ দেখে রাহুল বোন প্রিয়াঙ্কাকে ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমাদের পাপাকে যে হত্যা করেছিলেন, তাঁর মরদেহ দেখে আমার খুশি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু খুশি হতে পারছি কই? প্রিয়াঙ্কাও তখন বললেন, তাঁরও ঠিক একই ধরনের অনুভূতি হয়েছে।’

বাবার হত্যাকারীদের নিঃশর্ত ক্ষমা করে দিয়ে রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা যে উদারতা দেখিয়েছেন, তাতে তাঁদের মানবিক দিক ফুটে উঠেছে। আবার রাজনীতির ময়দানেও হয়তো কোনো একদিন তাঁরা এই উদারতার মূল্য পাবেন।

সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে, টাইমস অব ইন্ডিয়া, বিবিসি, ব্রিটানিকা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ওয়েবসাইট