‘আমার হৃদয়টা বেদনায় ভরা। এমনকি আজও। আমি কাঁদি, যখন ভাবি, হামলাকারীরা (ধর্ষকেরা) কীভাবে আমার জীবনটা শেষ করে দিল।’
১৯৯২ সালের ঘটনা। সুষমা (ছদ্মনাম) বলছিলেন, তখন ১৮ বছরের তরুণী তিনি। পরিচিত এক ব্যক্তি ভিডিও টেপ দেখানোর কথা বলে তাঁকে পরিত্যক্ত একটি গুদামঘরে নিয়ে যান। সেখানে থাকা ছয় থেকে সাতজন তাঁকে বেঁধে ফেলেন। পরে ধর্ষণ ও সেই দৃশ্য ধারণ করেন।
ওই দুর্বৃত্তরা ছিল ধনী ঘরের সন্তান, আজমিরের প্রভাবশালী কয়েকটি পরিবারের সদস্য। আজমির ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজস্থান রাজ্যের একটি শহর।
সুষমা বলেন, ‘ধর্ষণ করার পর তাঁদের একজন আমাকে লিপস্টিক কিনতে ২০০ রুপি দেন। আমি ওই অর্থ নিইনি।’
সুষমার মামলায় গত সপ্তাহে আদালত অভিযুক্ত ১৮ জনের মধ্যে ৬ জনের যাবজ্জীবন সাজা দেন। তবে তাঁরা দোষ স্বীকার করেননি। রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে বলে জানিয়েছেন তাঁদের আইনজীবীরা।
ওই ঘটনার ৩২ বছর পর গত সপ্তাহে সুষমা আদালতের কাছ থেকে বিচার পেয়েছেন। ধর্ষকদের দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
এমন দীর্ঘ অপেক্ষার পরও ধর্ষণের ওই ঘটনায় বিচার পাওয়ায় সুষমার যেমন আছে আত্মতৃপ্তি, তেমন আছে ক্ষোভও। বলছিলেন সে কথাই, ‘আমার বয়স আজ ৫০ বছর। অবশেষে মনে করি, আমি ন্যায়বিচার পেয়েছি। কিন্তু যা কিছু হারিয়েছি, সেসব আর ফেরত আনা সম্ভব নয়।’
ধর্ষণের মতো তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়ার পরও তাঁকে সমাজের কাছ থেকে এতটা বছর নানা অপবাদ ও কটূক্তি সইতে হয়েছে বলে জানান সুষমা। এমনকি অতীতের ওই ঘটনা স্বামী জানার পর তাঁদের বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়িয়েছে।
১৯৯২ সালে আজমিরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে একদল প্রভাবশালী দুষ্কৃতকারীর ধর্ষণ ও ব্ল্যাকমেলের শিকার হয় ১৬ জন স্কুলশিক্ষার্থী। সুষমা ওই কিশোরীদের একজন। সুষমার ঘটনায় মামলা হলে সেটি একটি বড় কেলেঙ্কারিতে গড়ায় ও সূচনা হয় ব্যাপক বিক্ষোভের।
আমার বয়স আজ ৫০ বছর। অবশেষে মনে করি, আমি ন্যায়বিচার পেয়েছি। কিন্তু যা কিছু আমি হারিয়েছি, সেসব আর ফেরত আনা সম্ভব নয়।সুষমা (ছদ্মনাম), ভুক্তভোগী নারী
সুষমার মামলায় গত সপ্তাহে আদালত অভিযুক্ত ১৮ জনের মধ্যে ৬ জনের যাবজ্জীবন সাজা দেন। তবে তাঁরা দোষ স্বীকার করেননি। রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে বলে জানিয়েছেন তাঁদের আইনজীবীরা।
অবশিষ্ট ১২ আসামির মধ্যে ৮ জনেরও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় ১৯৯৮ সালে। পরে তাঁদের মধ্যে ৪ জন উচ্চ আদালত থেকে খালাস পান। অপর আসামিদের সাজা কমে হয় ১০ বছর।
এই আটজনের বাইরে যে চার আসামি থাকেন, তাঁদের একজন আত্মহত্যা করেন। ২০০৭ সালে একজনের যাবজ্জীবন হয়। ছয় বছর পর তিনি খালাস পান। আরেকজন সংশ্লিষ্ট ছোট একটি ঘটনায় অভিযুক্ত হলেও পরে খালাস পন। এ ছাড়া অপরজন এখন পর্যন্ত পলাতক।
এ মামলা নিয়ে প্রতিবেদন করা ও বিচারকার্যে উপস্থিত থাকা সাংবাদিকদের একজন সন্তোষ গুপ্ত প্রশ্ন তোলেন, ‘আপনি কি এ রায়কে (২০ আগস্টের রায়) ন্যায়বিচার বলবেন? রায় হলেই তা ন্যায়বিচার নয়।’
একই রকম প্রশ্ন তুলেছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রেবেকা জন। তিনি বলেন, ‘বিচার বিলম্বিত করা, ন্যায়বিচার বঞ্চিত করার নামান্তর’—এ প্রবাদেরই আরেক উদাহরণ ওই মামলার রায়।
রেবেকা জন বলেন, ‘ওই রায় এদিকেই ইঙ্গিত করে যে আইনি ব্যবস্থার বাইরেও সমস্যা অন্তর্নিহিত রয়েছে। আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ভঙ্গুর ধরনের। আমাদের যা প্রয়োজন, তা হলো, মানসিকতার পরিবর্তন। কিন্তু এর জন্য কত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে?’
এ প্রসঙ্গে বাদীপক্ষের আইনজীবী বীরেন্দ্র সিং রাঠোর বলেন, ভুক্তভোগীদের প্রতারিত করতে, হুমকি দিতে ও প্রলুব্ধ করতে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা তাঁদের ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, তাঁরা ভুক্তভোগীদের ছবি তুলেছেন, ধর্ষণের ভিডিও করেছেন। ভুক্তভোগীদের মুখ বন্ধ রাখতে বা অন্যদের শিকার বানাতে এগুলো ব্যবহার করেছেন।
বীরেন্দ্র সিং বলেন, ‘উদাহরণ হিসেবে, এক ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা পরিচিত একজনকে একটি পার্টিতে আসার আমন্ত্রণ জানান। পরে তাঁকে নেশগ্রস্ত করেন। এরপর তাঁর ছবি তোলেন এবং তাঁর বান্ধবীকে তাঁদের কাছে না নিয়ে এলে ওই ছবি প্রকাশ করে দেওয়ার হুমকি দেন। এভাবেই লোকজনকে ভুক্তভোগী করেন তাঁরা।’
আর এমন ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শক্ত রাজনৈতিক ও সামাজিক যোগাযোগ থাকে বলে মন্তব্য করেন সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত।
সুষমার ঘটনা নিয়ে আইনজীবী বীরেন্দ্র সিং রাঠোর বলেন, ঘটনাটিতে বিক্ষোভ শুরু হলে সরকার অবশেষে কিছু জোরাল পদক্ষেপ নেয়। পুলিশ আসামিদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও ব্ল্যাকমেলের মামলা নথিভুক্ত করে। এটির তদন্তভার দেওয়া হয় রাজ্যের অপরাধ তদন্ত বিভাগের হাতে।
বীরেন্দ্র সিং আরও বলেন, এ মামলায় রায় পেতে ৩২ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে বেশকিছু কারণ, যেমন অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে গড়িমসি, বিবাদীপক্ষ থেকে বিচার বিলম্বিত করার কৌশল, মামলা পরিচালনায় তহবিলের ঘাটতি ও বিচারব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ বিষয়।
পরিশেষে ভুক্তভোগী সুষমা বলেন, ‘আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া বিষয় নিয়ে আমি কখনো ছলনা করিনি। আমার সঙ্গে যখন ওই অন্যায় করা হয়েছে, তখন আমি কিশোরী ও নিরপরাধ ছিলাম। এ ঘটনা আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। এখন আমার হারানোর কিছু নেই।’