নাটকীয়ভাবে দ্বিতীয় দফার শেয়ার (এফপিও) বিক্রি থেকে পিছিয়ে এল আদানি গোষ্ঠী। বুধবার রাতে এক বিবৃতি জারি করে আদানি গোষ্ঠী জানাল, অনিশ্চিত বাজারে এখনই তারা আর এফপিও নিয়ে এগোবে না। যাঁরা এই এফপিওতে লগ্নি করেছেন, তাঁদের সব টাকা ফিরিয়ে দেওয়া হবে।
বৃহস্পতিবার সকালে ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানি সংস্থার সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘লগ্নিকারীদের স্বার্থ সবার ওপরে। বাকি সবকিছুই গৌণ। বুধবারের শেয়ারবাজারের অস্বাভাবিক ওঠানামা বিবেচনা করে সংস্থার বোর্ড ঠিক করেছে, নৈতিক দিক থেকে এফপিও নিয়ে এগোনো উচিত হবে না।’
আদানি এন্টারপ্রাইজ ২০ হাজার কোটি রুপির এফপিও বাজারে ছেড়েছিল। গত মঙ্গলবার ছিল সেই শেয়ার কেনার শেষ দিন। শেষ পর্যন্ত বিদেশি লগ্নিকারীদের বদান্যতায় পুরো শেয়ার বিক্রি হয়ে গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদনের পর আদানি সাম্রাজ্যে যে ধস নামে, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আদানি এন্টারপ্রাইজের শেয়ারও।
বুধবারই সেই শেয়ারের দরপতন হয় সাড়ে ২৮ শতাংশ। বাজারবিশেষজ্ঞদের মতে, এ দরপতনের ফলে এফপিওতে লগ্নিকারীরা ইতিমধ্যেই ৩২ শতাংশ লোকসানের মুখ দেখেছেন। বুধবার বাজার বন্ধের সময় আদানি গোষ্ঠীর মোট ১০ সংস্থার মোট শেয়ারমূল্য এক দিনে গড়ে ১৪ শতাংশ পড়ে যায়। গত এক সপ্তাহে এই লোকসানের পরিমাণ গড়ে মোট ৩৯ শতাংশ।
এ পরিস্থিতিতেই গৌতম আদানির বিবৃতি। বৃহস্পতিবার সকালে সেই বিবৃতিতে এফপিও প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘চার দশক ধরে শিল্পোদ্যোগী হিসেবে বিপুল লগ্নিকারীর অকুণ্ঠ আশীর্বাদ ও সহযোগিতা পেয়েছি। এ কথা স্বীকারে দ্বিধা নেই, এ জীবনে যেটুকু অর্জন করেছি, তা তাঁদের আস্থা ও বিশ্বাসের দরুন। আমার সাফল্যের কারণও তাঁরা। তাঁদের কাছে আমি ঋণী। লগ্নিকারীদের স্বার্থই সবার আগে। বাকি সব গৌণ। সম্ভাব্য ক্ষতির হাত থেকে তাঁদের রক্ষার জন্যই আমরা এফপিও প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।’
গত বুধবার ছিল নরেন্দ্র মোদি সরকারের বাজেট পেশের দিন। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে এটাই ছিল মোদি সরকারের শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। রাজনৈতিক কারণেই তাই অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন বাজেটে সব মহলকে খুশি রাখার চেষ্টা করেছেন। বাজেট ভাষণে সেই জনমুখিতার পরিচয় যত পাওয়া গেছে, ততই তেজি হচ্ছিল শেয়ারবাজার।
একটা সময় সেনসেক্স ১২০০ পয়েন্ট উঠে ৬১ হাজার পেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদনের ধাক্কায় বুধবার দুপুরে সুইজারল্যান্ডের ক্রেডিট সুইস ব্যাংক আদানিদের ঋণের পরিবর্তে বন্ড গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত জানানোয় আদানিদের শেয়ারের দাম ঝুপঝুপ করে কমতে থাকে। ফলে বিএসই ইনডেক্স এক ধাক্কায় ২০০০ পয়েন্টে নেমে যায়। দিনের শেষে শেয়ারবাজার ১৫৮ পয়েন্ট বাড়তি সংগ্রহ করলেও আদানিদের সব সংস্থা লোকসানে চলে যায়। এরপরই এফপিও তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়।
বুধবার আদানি এন্টারপ্রাইজের শেয়ারের দরপতন হয় ২৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। গত এক সপ্তাহে এ সংস্থার মোট দরপতন হয়েছে ৩৮ শতাংশ। বুধবার আদানি পোর্টসের শেয়ারের দাম পড়েছে ২০ শতাংশ, এক সপ্তাহে ৩৫ শতাংশ। অম্বুজা সিমেন্টের লোকসান ১৭ শতাংশ, এক সপ্তাহে ৩৩ শতাংশ। আদানি টোটালের দরপতন সবচেয়ে বেশি। বুধবার ১০ শতাংশ দাম পড়লেও এক সপ্তাহে কমেছে ৫১ শতাংশ। আদানি গ্রিনের এক সপ্তাহের লোকসান ৪০ শতাংশ, আদানি উইলমারের ২৩ শতাংশ, এসিসির ২১ শতাংশ, আদানি পাওয়ারে ২৩ শতাংশ, আদানি ট্রান্সপোর্ট ৩৭ শতাংশ ও এনডিটিভির এক সপ্তাহের মোট দরপতন ১৭ শতাংশ।
হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদনে শেয়ারবাজারে বিপুল কারচুপি করে আদানি গোষ্ঠীর ধনী হওয়ার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে গৌতম আদানির অবস্থানেরও পরিবর্তন হয়েছে। কদিন আগেও ফোর্বসের তালিকায় যিনি ছিলেন বিশ্বের তৃতীয় ধনকুবের, গত বুধবার তিনি নেমে এসেছেন ১৫ নম্বরে।
হিনডেনবার্গের প্রতিবেদন ভারতের গণতন্ত্র ও আর্থিক অগ্রগতির ওপর আক্রমণ বলে অভিযোগ করেছিল আদানি গোষ্ঠী। তারা বলেছিল, বাজারে পুঁজি সংগ্রহ নিয়ে তাদের কোনো সম্যক ধারণা নেই। তাদের প্রতিবেদন সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আদানিদের বক্তব্য খারিজ করে হিনডেনবার্গ জানিয়েছিল, ভারতীয় গণতন্ত্র ও বিকাশের প্রতি তাদের পূর্ণ সম্মান রয়েছে। আদানিরা জাতীয়তাবাদের নামাবলি পড়ে নিজেদের কারচুপি আড়াল করতে পারবে না।
আদানিরা এর আগে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দিয়েছিল। হিনডেনবার্গ রিসার্চ তাদের স্বাগত জানিয়েছিল। এখন দেখার বিষয়, যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে আদানি গোষ্ঠী মামলা করে কি না এবং প্রতি সংস্থার শেয়ারের দরপতন কীভাবে প্রতিহত করে। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয় এখনো পর্যন্ত হিনডেনবার্গের অভিযোগ নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি।