ভারতের লোকসভা নির্বাচনের প্রথম ধাপে পশ্চিমবঙ্গসহ পূর্ব ভারতের ১০ রাজ্যে মোট ২২টি আসনে গতকাল শুক্রবার ভোট হয়েছে। কিছু বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ বাদে মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই এসব রাজ্যে ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ভারতের ১৭টি রাজ্য ও ৪টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ১০২ আসনে নির্বাচনে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ভোট পড়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ, যা ২০১৯ সালের তুলনায় ১০ শতাংশ কম। অবশ্য শেষ পর্যন্ত ভোটের হার খানিকটা বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। ১৭ রাজ্য ও ৪ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে সর্বোচ্চ ৭৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ ভোট পড়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ারে এই বিপুল পরিমাণে ভোট পড়ায় তৃণমূল কংগ্রেস এতটাই উচ্ছ্বসিত যে তারা এদিনই রাতে বিজয় মিছিল বের করেছে, যা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। তৃণমূলের স্থানীয় নেতারা বলছেন, আজকের ভোটের পরে তাঁরা ৪ জুন ফল ঘোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করার কোনো কারণ দেখছেন না।
তৃণমূলের মিছিলকে নাটক বলে ব্যাখ্যা দিয়ে বিজেপি বলেছে, পরবর্তী ধাপের নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে উত্তরবঙ্গের তিন আসনে এই প্রহসন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বেশি ভোট তাদের সুবিধা করে দিয়েছে বলে দাবি করে তৃণমূল কংগ্রেস গতকাল রাতেই তিন আসনে বিজয় মিছিল বের করে। তাদের আত্মবিশ্বাসের এই কারণের একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন স্থানীয় মানুষ। কোচবিহারের এক পরিযায়ী শ্রমিক দিলীপ দাস প্রথম আলোকে বলেন, এবার ভোট দিতে বিরাট সংখ্যক মানুষকে অন্য রাজ্য থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। এদের ভোটের বড় অংশই তৃণমূলের দিকে যাবে বলে তিনি মনে করেন।
বিজয় মিছিল চলাকালে টেলিফোনে স্থানীয় এক সাংবাদিক প্রথম আলোকে বলেন, অন্তত ৪০ শতাংশ বুথে বিজেপি নির্বাচনী এজেন্ট দিতে পারেনি। সেই কারণে জেতার ব্যাপারে নিশ্চিত তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১৯ সালে নির্বাচনে এই তিন আসনই পেয়েছিল বিজেপি।
সম্ভবত এই কারণেই বিজেপির নেত্রী অগ্নিমিত্রা পাল বলেছেন, অতীতে যেভাবে বিহারে ভোট হতো, সেই কায়দায় মানুষকে ভয় দেখিয়ে, খুন করে তৃণমূল কংগ্রেস ভোট করিয়েছে। অবশ্য অগ্নিমিত্রা বললেও গতকাল তিন আসন থেকে কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি।
ভারতে প্রথম ধাপের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গে। সবচেয়ে বেশি সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে কোচবিহার থেকে। সেখানে দিনহাটা মহকুমার ভেটাগুড়িতে তৃণমূলের এক স্থানীয় নেতা অনন্ত বর্মণকে মারধর করা হয়েছে বলে অভিযোগ। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আহত কর্মীকে দেখে বেরিয়ে কোচবিহার আসনের প্রার্থী উদয়ন গুহ বলেন, ‘পরিকল্পিতভাবে অনন্ত বর্মণের ওপর হামলা করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন এবং পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকায় আমাদের ব্লক সভাপতিকে নির্মমভাবে পেটানো সম্ভব হয়েছে।’
কোচবিহারেরই চান্দামারিতে বিজেপি ও তৃণমূল সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের জেরে মাথা ফেটে যায় এক বিজেপি নেতার। তৃণমূল কংগ্রেস হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ।
তৃণমূলের বক্তব্য, তাদের ভোটার ও কর্মীদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়ায় এই সংঘর্ষ ঘটেছে। একাধিক বুথে এজেন্টদের বসতে দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করেছে দুই পক্ষ। অস্থায়ী দলীয় নির্বাচনী কেন্দ্রে আগুন, ভোটার স্লিপ এবং প্রচারপত্র পুড়িয়ে দেওয়া, ভোটদানে বাধা থেকে ভোট চলাকালে গন্ডগোল সৃষ্টির নানান চেষ্টা করেছে বিজেপি।
তবে প্রথম ধাপে ২০১৯ সালের মতো বড় ধরনের সংঘর্ষ এবং তার জেরে ভোটার বা কর্মীদের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি।
উত্তর-পূর্ব ভারতের সব কটি রাজ্যের ১৫ আসনে গতকাল ভোট হয়েছে। বড় ধরনের ভোট বর্জনের আশঙ্কা থাকলেও মণিপুরে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ৬৮ শতাংশ। বরং ভারতের নির্বাচন কমিশন বিপদে পড়েছে নাগাল্যান্ড রাজ্যে, যেখানে অন্তত ছয়টি জেলায় ভোট বর্জনের ডাক দিয়েছিল ইস্টার্ন নাগাল্যান্ড পিপলস অর্গানাইজেশন নামের একটি সংগঠন। পৃথক রাজ্যের দাবিতে সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে।
ওই সব জেলার প্রায় কোনো বুথেই গতকাল ভোটার দেখা যায়নি। বিষয়টি অবাক ও অসন্তুষ্ট করেছে নির্বাচন কমিশনকে। কমিশন সূত্রে জানানো হয়েছে, মাওবাদী অধ্যুষিত ছত্তিশগড়েও যেখানে ৬৩ শতাংশ ভোট পড়েছে, সেখানে নাগাল্যান্ডে ভোটের হার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ৫০ শতাংশের কিছু বেশি। এর প্রধান কারণ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মানুষের ভোট দিতে না আসা। ওই ছয় জেলায় প্রায় কোনো ভোট পড়েনি বলে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে।
এ ঘটনার জেরে নাগাল্যান্ড রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী কর্মকর্তা জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে ইস্টার্ন নাগাল্যান্ড পিপলস অর্গানাইজেশনের (ইএনপিও) বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন। কমিশনের বক্তব্য, সংগঠন মানুষকে ভোট দিতে দেয়নি। যদিও ইএনপিওর তরফে বলা হয়েছে, ভোট বর্জনের ডাক দেওয়া যেকোনো সংগঠনের গণতান্ত্রিক অধিকার। মানুষ সেই ডাকে সাড়া দিলে তাদের কিছু করার নেই। কিন্তু সংগঠনের তরফে ভোটারদের বুথে যেতে কোথাও বাধা দেওয়া হয়নি।
উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুরে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ হয়েছে। নানা জায়গা থেকে বুথ দখল, ইভিএম ভাঙচুর এবং বিক্ষিপ্ত গোলাগুলির খবর পাওয়া গেছে। এসব ঘটনায় অন্তত তিনজন আহত হয়েছেন।
মণিপুর কংগ্রেসের সহসভাপতি দেবব্রত সিং বলেছেন, তাঁরা একাধিক বুথে ফের নির্বাচন করানোর দাবি তুলবেন। মেইতেই ও কুকি—দুই পক্ষই ভোট বর্জনের ডাক দেওয়া সত্ত্বেও মোটামুটি ভালোই ভোট পড়েছে।