বন্দিমুক্তি নিয়ে বিজেপিশাসিত গুজরাট সরকারের মাপকাঠি নতুন বিতর্কের জন্ম দিল। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গায় বিলকিস বানোর ধর্ষক ও বিলকিসের পরিবারের সদস্যদের হত্যাকারীদের মুক্তি দেওয়া হলেও সবরমতী এক্সপ্রেস ট্রেনে অগ্নিসংযোগের ঘটনাটিকে একই দৃষ্টিতে বিবেচনা করতে রাজি নয় রাজ্য সরকার।
গত শুক্রবার ওই মামলার শুনানি চলাকালে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা রাজ্য সরকারের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টকে বলেন, অপরাধীরা শুধু ট্রেনে ঢিল ছুড়েছিলেন, তা নয়। তাঁদের ঢিল ছোড়ার উদ্দেশ্য ছিল আগুনলাগা কামরা থেকে যাত্রীরা যাতে বের হতে না পারেন, তা নিশ্চিত করা।
গুজরাটের গোধরা স্টেশনে সবরমতী এক্সপ্রেসে আগুন লাগানোর ঘটনা রাজ্যে বিধ্বংসী দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটায়। ওই অগ্নিসংযোগের ফলে একটি কামরা সম্পূর্ণভাবে পুড়ে যায়। মারা যান ৫৯ জন করসেবক, যাঁরা উত্তর প্রদেশের অযোধ্যা থেকে ফিরছিলেন। ওই ঘটনায় রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে লেগে যায় দাঙ্গা, যাতে সরকারি হিসাবে মারা যান ১ হাজার ৪৪ জন, যাঁদের মধ্যে ৭৯০ জন ছিলেন মুসলমান, ২৫৪ জন হিন্দু।
বেসরকারি মতে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা দুই হাজারের বেশি। সেই দাঙ্গায় গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন অন্তঃসত্ত্বা বিলকিস বানো। তাঁর শিশুকন্যাসহ পরিবারের সাতজনকে ধর্ষকেরা হত্যাও করেছিলেন। সেই ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত ১১ জনকে গুজরাট সরকার কিছুদিন আগে মুক্তি দিলে দেশজুড়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। মুক্তির পর অপরাধীদের ফুল–মালা দিয়ে বরণ করাও হয়।
গুজরাট সরকারের দাবি, ১৯৯২ সালে রাজ্য সরকারের সাজা মওকুফ নীতি অনুযায়ী ১৪ বছর কারাবাসের পর নিয়ম মেনেই ওই ১১ জন মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া রাজ্য সরকারের দাবি, দোষীরা কারাবাসের সময় ভালো ব্যবহারও করেছিলেন। যদিও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০১৪ সালে যে নীতি গ্রহণ করে, তাতে ধর্ষণ ও খুনের আসামিদের সাজা মওকুফ না করার কথা বলা হয়েছে।
গুজরাট সরকারের ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিলকিস বানো নিজেই সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন।
যে যুক্তিতে ধর্ষক–খুনিদের মুক্তি দেওয়া হয়, সেই এক মাপকাঠি সবরমতী এক্সপ্রেসে যাঁরা ঢিল ছুড়েছিলেন, তাঁদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে গুজরাট সরকার কিন্তু এখনো রাজি নয়। অগ্নিসংযোগ ও ঢিল ছোড়ার ঘটনায় দোষীরা প্রত্যেকে ১৭–১৮ বছর জেল খাটছেন।
তাঁদের জামিনের আবেদন ২০১৮ সাল থেকে সুপ্রিম কোর্টে বিবেচনাধীন। শুক্রবার তাঁদের মুক্তির বিষয়টি ওঠে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় ও বিচারপতি পি এস নরসিংহের বেঞ্চে। তাঁদের পর্যবেক্ষণ, দোষীদের মধ্যে অনেকের অপরাধ ট্রেনে ইট–পাথর ছোড়ার। তাঁরাও ১৭–১৮ বছর ধরে কারাবাস করছেন। তাঁদের মুক্তি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা দরকার।
সলিসিটর জেনারেল সেই সময় এজলাসকে বলেন, বিষয়টিকে শুধু ইটপাটকেল ছোড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। তাঁরা ঢিল ছুড়েছিলেন যাত্রীরা যাতে আগুন লাগা কামরা থেকে বের হতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে। সলিসিটর জেনারেল অবশ্য বলেছেন, তাঁদের মুক্তির বিষয়টি রাজ্য সরকার বিবেচনা করে দেখবে।
বিলকিস বানোর ধর্ষক ও বিলকিসের পরিবারের সদস্যদের হত্যাকারী ১১ জনই হিন্দু ব্রাহ্মণ। সবরমতী এক্সপ্রেসে অগ্নিসংযোগ ও যাত্রীদের যাঁরা পুড়িয়ে মেরেছিলেন, তাঁরা মুসলমান। ২০১৭ সালে গুজরাট হাইকোর্ট ওই ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত ১১ জনের ফাঁসির হুকুম রদ করেন, ২০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন, ৬৩ জনকে মুক্তি দেন। হাইকোর্টের সেই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানায় গুজরাট সরকার। ২০১৮ থেকে সেই আবেদন বিবেচনাধীন।