খালিস্তানি নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যাকাণ্ড নিয়ে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো যে অভিযোগ করেছেন, তার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি আজ বৃহস্পতিবার এই কথা বলেন।
ব্রিফিং থেকে স্পষ্ট, কানাডায় বিচ্ছিন্নতাবাদী খালিস্তানি শিখদের উপস্থিতি এবং সে দেশের সরকারে তাদের প্রভাবের দরুন দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। বরং আরও অবনতি হতে পারে।
মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ের বাগচি বলেন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললেও নিজ্জরের হত্যাকাণ্ড ও সে–সংক্রান্ত অভিযোগ সম্পর্কে তারা আজও নির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিল্লিকে দেয়নি।
কানাডার সংসদে প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর মন্তব্য ও পরবর্তী ঘটনাবলির পর বৃহস্পতিবারই ছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রথম সাপ্তাহিক ব্রিফিং। কাজেই অধিকাংশ প্রশ্নই ছিল এ–সংক্রান্ত। সেই সব প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র স্বীকার করেন, কানাডার নাগরিকদের ভিসা দেওয়া ভারত আপাতত বন্ধ রেখেছে। কানাডায় ভারতীয় কূটনীতিকদের প্রাণের ভয় দেখানো তার প্রধান কারণ। ওই ধরনের হুমকিতে দূতাবাসের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে। তাই ভিসা দেওয়া সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের এই টানাপোড়েনের মধ্যেই কানাডায় গতকাল বুধবার রাতে আরও এক ‘খালিস্তান আন্দোলন’–এর নেতা সুখদুল সিংয়ের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেল। অবশ্য ভারতের চোখে সুখদুল সিং ওরফে সুখা দুনেকা একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী শিখ সন্ত্রাসী। তিনি খালিস্তানি জঙ্গি আর্শদীপ সিংয়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। আর্শদীপকে ভারত অনেক দিন ধরে দেশে ফেরাতে চাইছে। এ অবস্থায় দুই দেশের কুটনৈতিক সম্পর্কের আরও অবনতির আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা।
তবে বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে দুনেকার মৃত্যু নিয়ে কিছু বলেননি মুখপাত্র। গত জুনে ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশে নিজ্জরের মৃত্যু নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় দুই দেশই দূতাবাস থেকে কূটনৈতিক কর্তাদের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে।
কারণ হিসেবে অরিন্দম বাগচি বলেন, দুই দেশের কতজন দূতাবাসে থাকবেন, তার মধ্যে একটা সামঞ্জস্য থাকা জরুরি। ভারতের তুলনায় কানাডার কর্তা সংখ্যা অনেক বেশি। তা ছাড়া ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কানাডার কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপও নজরে আসছিল। সেদিকে ভারত নজর দিয়েছে এবং কর্তাদের উপস্থিতির মধ্যে সামঞ্জস্য আনা হচ্ছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, মনে হয় কানাডার দূতাবাসে কর্তাদের উপস্থিতির হার কমে যাবে। সে নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কথা হচ্ছে।
হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে ভারতীয় এজেন্টদের জড়িত থাকার অভিযোগ সে দেশের পার্লামেন্টের বিশেষ অধিবেশনে তোলেন প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো স্বয়ং। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র স্পষ্ট করে বললেন, তাঁর পেছনে রাজনীতিই প্রধান কারণ। শিখদের দল নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থন নিয়ে ট্রুডো দেশ চালাচ্ছেন। জগমীত সিং সেই দলের নেতা। ভারত তাঁকে খালিস্তানিদের সহযোগী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদদাতা বলে মনে করে।
নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো ভারতের যোগসাজশের অভিযোগ তোলার সঙ্গে সঙ্গেই জগমীত বিবৃতি দিয়ে নয়াদিল্লির কড়া নিন্দা জানান। তাঁদের প্রবল চাপ প্রধানমন্ত্রীকে সহ্য করতে হচ্ছে বলে ভারতের বিশ্বাস। অরিন্দম বাগচি বৃহস্পতিবার ব্রিফিংয়ে সেটাই বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন।
মুখপাত্র বলেন, ‘ওই অভিযোগের পেছনে কিছুটা পক্ষপাতিত্ব আছে বলেই আমাদের ধারণা। তাঁরা অভিযোগ এনেছেন ও সেইমতো কাজও করেছেন। আমরা মনে করি, কানাডা সরকারের আনা ওই অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’
এই মন্তব্যের পাশাপাশি আরেক প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র বলেন, ‘ওই বিষয়ে (নিজ্জর হত্যা) আগে বা পরে কানাডা কোনো তথ্যই আমাদের দেয়নি। আমরা জানতে আগ্রহী, তাদের কাছে এ বিষয়ে কী ধরনের তথ্য রয়েছে। আমরা চাই, তারা আমাদের সেসব তথ্য দিক। কিন্তু এখনো কানাডা ওই বিষয়ে কিছুই দেয়নি।’
অথচ ভারত যে সে দেশে বসবাসকারী ওই সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট তথ্য দিয়েছে, মুখপাত্র সে কথা জানিয়ে অরিন্দম বাগচি বলেন, ‘কানাডায় বসে যাঁরা অপরাধমূলক কাজকর্ম করে চলেছেন, তাঁদের সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য ভারত জানিয়েছে। কিন্তু কানাডা আজ পর্যন্ত তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’
কানাডায় ভারতীয় হাইকমিশন ও কনস্যুলেট কর্তাদের হুমকি দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে অরিন্দম বলেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সে দেশের কর্তব্য। ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী ভারত বিদেশি দূতাবাস কর্মীদের নিরাপত্তা যেমন নিশ্ছিদ্র করেছে, ভারত চায় কানাডাও তেমনি ভারতীয় কূটনীতিকদের বিষয়টি দেখবে। এটা তাদের কর্তব্য।
এই নিরাপত্তাহীনতাই যে সাময়িক ভিসা বন্ধের কারণ, সে কথা মুখপাত্র জানাতে ভোলেননি। তিনি বলেন, নিরাপত্তাহীনতার দরুনই ভিসা দেওয়ার কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। কর্মীদের হুমকি ও তার বিরুদ্ধে কানাডা সরকারের ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তবে যাঁদের ভিসা রয়েছে কিংবা যাঁদের অন্য ধরনের নথি রয়েছে, তাঁদের ভারতে আসতে কোনো বাধা নেই বলে অরিন্দম জানিয়েছেন।
ব্রিফিংয়ে ভারত স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে, সন্ত্রাসবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য কানাডা এই মুহূর্তে সবচেয়ে নিরাপদ দেশ। বাগচি বলেন, সম্মান রক্ষা কিংবা সম্মানহানি রুখতে যদি কোনো দেশকে সচেষ্ট হতে হয়, সেটা কানাডাকেই হতে হবে। এই দেশটা ক্রমেই সন্ত্রাসবাদী ও সংগঠিত অপরাধীদের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক সম্মান রক্ষার প্রশ্ন উঠলে ওই দেশটিকে গুরুত্বের সঙ্গে তা ভাবতে হবে। ভারত চায়, যাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের নির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে, তাদের জন্য কানাডা যেন নিরাপদ আশ্রয়ভূমি না হয়ে ওঠে।
অরিন্দম বাগচি বললেন, বেশ কয়েক বছর ধরে অন্তত ২০-২৫ জনের বেশি নাম কানাডাকে দেওয়া হয়েছে। এঁদের ভারত দেশে ফেরাতে চায়। কার বিরুদ্ধে কানাডা ব্যবস্থা নিচ্ছে দেখতে চায়। কিন্তু কানাডা কিছুই করেনি। কাউকে ফেরায়নি, কারও বিরুদ্ধে কোনো রকম ব্যবস্থাও নেয়নি। কোনোভাবেই তারা ভারতকে সাহায্য করছে না।