শাসক বিজেপির বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হওয়ার গুরুত্বের ওপর আরও একবার জোর দিয়ে কংগ্রেসের সাবেক সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী লিখেছেন, ‘ক্ষমতার অপব্যবহার করে এবং জাত, ধর্ম, ভাষা ও লিঙ্গে ভেদাভেদ এনে যারা দেশবাসীকে লড়াইয়ে নামাচ্ছে, তারাই দেশদ্রোহী। তাদের বিরুদ্ধেই সবাইকে একজোট হতে হবে।’
ক্ষমতার অপব্যবহার করে এবং জাত, ধর্ম, ভাষা ও লিঙ্গে ভেদাভেদ এনে যারা দেশবাসীকে লড়াইয়ে নামাচ্ছে, তারাই দেশদ্রোহী। তাদের বিরুদ্ধেই সবাইকে একজোট হতে হবে।
তিন দিন আগেও বিরোধী জোটের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে সোনিয়া লিখেছিলেন সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’য়। এবার লিখলেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায়। মুশকিল হলো, জোট গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধ হলেও বাস্তবে তা রূপায়ণের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হচ্ছে নানা রকমের সংশয়। ভিন্নধর্মী এসব ইঙ্গিত ভিন্ন ভিন্ন ধারণারও জন্ম দিচ্ছে। ফলে বিরোধী ঐক্যের বাস্তবায়ন ঘিরে প্রশ্ন উঠছে।
বিহার থেকে দিল্লি এসে সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার (জেডিইউ), উপমুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদব (আরজেডি) এ সপ্তাহেই কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে ও রাহুল গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক করেন। তিন দলের অন্য নেতারাও সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট সামনে রেখে বিরোধী ঐক্য গঠনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে সেই বৈঠকে ঠিক হয়েছিল, এনসিপি, আরজেডি, ডিএমকের মতো ইউপিএর জোটসঙ্গীদের সঙ্গে কথা বলবে কংগ্রেস। একই সঙ্গে যারা কংগ্রেস ও বিজেপির সঙ্গে সমদূরত্ব রেখে চলছে, সেই তৃণমূল কংগ্রেস, আপ, ওয়াইএসআর কংগ্রেস কিংবা বিজেডির মতো দলের সঙ্গে কথা বলবেন নীতীশ কুমার। আপ নেতা ও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সঙ্গে নীতীশ বৈঠকও করেন। পাশাপাশি এমন কিছু ঘটনা ঘটে চলেছে, যা এ প্রচেষ্টা নিয়ে তুলে দিচ্ছে অনেক ধরনের প্রশ্ন। সৃষ্টি হচ্ছে বিভ্রান্তির।
প্রথম বিভ্রান্তি এনসিপি নেতা শারদ পাওয়ারকে ঘিরে। খাড়গে-নীতীশ-রাহুল-তেজস্বী বৈঠকের আগে মহারাষ্ট্রের এই প্রবীণ নেতা শিল্পপতি গৌতম আদানি প্রসঙ্গে অন্য পথে হেঁটে তাঁর প্রশংসা করলেন এবং বললেন, হিনডেনবার্গ প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধীদের যুগ্ম সংসদীয় কমিটির (জেপিসি) দাবির সঙ্গে তিনি সহমত নন। কারণ, তাতে লাভের লাভ কিছুই হবে না, যেহেতু জেপিসিতে প্রাধান্য থাকবে বিজেপিরই। এ নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই বিরোধী ঐক্যের সলতে পাকানোর চেষ্টা শুরু খাড়গে-নীতীশদের। সেই প্রচেষ্টার রেশ থাকতে থাকতে পাওয়ার গত বৃহস্পতিবার দিল্লি এসে খাড়গে-রাহুলের সঙ্গে বৈঠকের পর জানালেন, অন্য বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনার দায়িত্ব শুধু নীতীশকে নয়, একটা কমিটি গড়ে তাঁকে দেওয়া উচিত। সেই কমিটিতে কংগ্রেস, এনসিপি, এসপি, সিপিএমকেও রাখা হোক।
প্রশ্ন উঠছে পাওয়ারের এ প্রস্তাব নিয়ে। কেন তিনি নীতীশের একার ওপর দায়িত্ব দিতে চাইছেন না? কেন অন্যদের জুড়তে চাইছেন? তাহলে কি তাঁর এই কথার মধ্য দিয়ে বিজেপির ধারণারই প্রতিফলন ঘটছে? কারণ, বিজেপি মনে করে নীতীশ নিজেকে বিরোধী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরার তৎপরতা শুরু করেছেন। পাওয়ার কি নীতীশের সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষার পথে কাঁটা বিছাতে চাইছেন?
এ প্রশ্নের যেমন কোনো সদুত্তর এখনো নেই, জানা নেই পাওয়ারের ওই প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে কার কী মত, তেমনই বোঝা যাচ্ছে না পাওয়ার কেন কর্ণাটকের ভোটে কিছু কেন্দ্রে দলীয় প্রার্থী দিতে চাইছেন। দিল্লি থেকে গতকাল শুক্রবার মুম্বাই ফিরে পাওয়ারের এ ইচ্ছার মধ্য দিয়ে প্রশ্ন উঠছে, কর্ণাটকে বিজেপির সুবিধা করে দিতে পাওয়ার সচেষ্ট কি না?
সংশয়ের কারণ, বিজেপির সঙ্গে পাওয়ারের অনেককালের ‘বোঝাপড়া’। গৌতম আদানির সঙ্গে তাঁর সখ্যও দীর্ঘদিনের। এ সম্পর্কের কারণ ছাড়াও মহারাষ্ট্রে বিজেপি ২০২৪ সালের কথা মাথায় রেখে এনসিপি ভাঙানোর পরিকল্পনা করছে।
এ সংশয়ের কারণ বিজেপির সঙ্গে পাওয়ারের অনেককালের ‘বোঝাপড়া’। গৌতম আদানির সঙ্গে তাঁর সখ্যও দীর্ঘদিনের। এই সম্পর্কের কারণ ছাড়াও মহারাষ্ট্রে বিজেপি ২০২৪ সালের কথা মাথায় রেখে এনসিপি ভাঙানোর পরিকল্পনা করছে। শিবসেনার ঘর ভাঙার পর পাওয়ারের ভাইপো অজিত পাওয়ারকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি তা করতে চাইছে বলে রাজনীতি সরগরম। এই চেষ্টা বিজেপি আগেও করেছিল। সফল হয়েও ধরে রাখতে পারেনি।
ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন এনসিপির সর্বভারতীয় দলের স্বীকৃতি কেড়ে নিয়েছে। অন্য রাজ্যে ভোটের হার বাড়াতে সেই জন্যই কি শারদ পাওয়ার কর্ণাটকে প্রার্থী দেওয়ার কথা শোনালেন? হতে পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে যে বিজেপিরই পোয়াবারো? পাওয়ার তা হলে কেন তা করতে চলেছেন? প্রশ্নটি উঠে গেছে। বিরোধী জোট নিয়ে শারদ পাওয়ার ঠিক কী ভাবছেন, সেই উত্তর যদিও এখনো স্পষ্ট নয়।
আলোচনায় উঠে এসেছে কংগ্রেসের ভূমিকাও। হিন্দুত্ববাদের প্রবক্তা সাভারকরকে নিয়ে রাহুল গান্ধীর মন্তব্যের পর উদ্ধব ঠাকরের সঙ্গে রাহুলের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। শারদ পাওয়ারের মধ্যস্থতা ও রাহুলের নমনীয় হওয়া পরিস্থিতির সামাল দেয়। মুম্বাইয়ে গিয়ে উদ্ধব ঠাকরের সঙ্গে রাহুল কথা বলবেন বলেও শোনা যাচ্ছে। রাজনৈতিক নির্যাস, বিরোধী জোট গঠনের আবহে এমন কিছু না করা, যাতে জোটবদ্ধতার পথে কাঁটা বিছায়। বিজেপির সুবিধা হয়। কিন্তু দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী আপ নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে আবগারি নীতি নিয়ে জেরা করতে সিবিআই ডেকে পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে দিল্লি প্রদেশ কংগ্রেস যেভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, তা বিস্ময়কর!
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অনিল চৌধুরী গতকাল রাতেই বিবৃতি দিয়ে বলেন, কেজরিওয়ালই নাটের গুরু। অন্য দুই মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁরও ঠিকানা হবে তিহার জেল। অথচ রাহুল গান্ধীর সংসদ সদস্য পদ কেড়ে নেওয়ার পর কেজরিওয়াল ও আপ নেতৃত্ব বিজেপির বিরোধিতা করে কংগ্রেসের পাশে দাঁড়িয়েছিল। কংগ্রেস কেন সেই পথে হাঁটল না? বিরোধী ঐক্যের স্বার্থে?
এই ধাঁধার জটিলতা কাটছে না। মুখে ঐক্যের কথা বলেও বিভিন্ন দলের বিভিন্ন নেতা সময়-সময় যে আচরণ করছেন, যেভাবে দলীয় রাজনীতির টানাপোড়েন প্রকাশ করছেন, তাতে ঐক্য প্রতিষ্ঠা কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিচ্ছে। সেই সুযোগ কাজে লাগাতে চেষ্টার কসুর করছে না বিজেপি।
সোনিয়া গান্ধী লিখেছেন, ঘৃণার পরিবেশ গড়ে বিচার বিভাগকে লাগাতার নিশানা করে ধর্মীয় ভেদাভেদ প্রকটের মাধ্যমে বিজেপি যেভাবে কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চাইছে, তার বিরুদ্ধে দেশের নাগরিক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। জাতির স্বার্থে সবাইকে একজোট হতে হবে। এটাই সময়ের দাবি।
অবশ্য অন্যান্য দলের পাশাপাশি কংগ্রেস নিজে কতটা সেই দাবি মেনে সংযত আচরণ করছে এবং সংঘবদ্ধ হচ্ছে, সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।