বিজেপি ও কংগ্রেসের লোগো
বিজেপি ও কংগ্রেসের লোগো

বিচ্ছিন্নতাবাদী–জামায়াতের সঙ্গে হাত মিলিয়েও কাশ্মীরে সুবিধা করতে পারল না বিজেপি

অতিমাত্রায় জাটনির্ভরতা ও দলীয় কোন্দল হরিয়ানায় কংগ্রেসের বিস্ময়কর হারের কারণ। একই রকম শিক্ষা কংগ্রেস পেল জম্মু–কাশ্মীরেও। জম্মুতে বিজেপির প্রবল উপস্থিতির কারণে কংগ্রেস প্রায় ধুয়ে মুছে সাফ। ওই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে যে ছয়টি আসন কংগ্রেস জিতেছে, তার কৃতিত্ব ন্যাশনাল কনফারেন্সের (এনসি)।

কীভাবে জয়ের মুখ থেকে হার ছিনিয়ে নিতে হয়, হরিয়ানায় কংগ্রেস তা আরও একবার প্রমাণ করল। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ভূপিন্দর সিং হুডার ওপর অতিমাত্রায় নির্ভর করা যে হারাকিরি হয়েছে, কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব ভোটের পর নিশ্চয় তা অনুধাবন করতে পারছে। জাটদের অবিসংবাদিত এই নেতা ৯০টির মধ্যে ৭২ আসনে তাঁর পছন্দের প্রার্থী দিয়েছিলেন। তা করতে গিয়ে তিনি যেমন বিরূপ করেছেন দলিত নেত্রী কুমারী শৈলজাকে, তেমনই বিমুখ করেছেন রণদীপ সুরযেওয়ালা ও কিরণ চৌধুরীর মতো জাট নেতাদের, যাঁরা রাজ্য রাজনীতিতে হুডার অনুগামী নন।

হরিয়ানায় ভোটের আগে কিরণ দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন। তাঁর কন্যা শ্রুতি জিতেছেন বিপুল ভোটে। শৈলজাকে প্রচারে গুরুত্ব না দেওয়ায় তিনি দর্শকের ভূমিকায় ছিলেন। দুই সপ্তাহ ঘরে বসে ছিলেন এই দলিত নেত্রী। ভোটের ফল দেখাচ্ছে, জাট সমর্থন বিভাজিত হয়েছে বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে, যা মনে করা হয়েছিল হুডার দৌলতে প্রায় পুরোটাই আসবে কংগ্রেসের অনুকূলে। অন্যদিকে বিজেপি ছেঁকে তুলেছে তফসিল জাতির সমর্থন।

অতিমাত্রায় এই হুডানির্ভরতাই কংগ্রেসের পতনের কারণ। সম্ভাব্য জাটশাহি ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছিল দলিত ও অনগ্রসরদের। বিজেপি সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে অ–জাট জনতার মেরুকরণ ঘটিয়ে। ১০ বছর আগে যেভাবে অ–জাট মনোহরলাল খাট্টারকে তুলে ধরে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিল, ঠিক সেভাবে ভোটের ছয় মাস আগে নতুন অ–জাট নেতা নায়েব সিং সাইনিকে দায়িত্ব দিয়ে তারা জাটশাহির বিরুদ্ধে অ–জাটদের মন জিতে নিল। হরিয়ানার রাজনীতিতে জাটদের প্রাধান্য থাকলেও সেই রাজ্যে জাট জনসংখ্যা মাত্র ২৭ শতাংশ। বাকিদের বিজেপি তার দিকে জড়ো করতে পেরেছে নেতৃত্বের দৃঢ়তায়।

হরিয়ানায় কংগ্রেসের হার যতটা বিস্ময়কর, ঠিক ততটাই বিস্ময়ের জনমত সমীক্ষা ও বুথফেরত সমীক্ষকেরা কী করে সবাই একযোগে কংগ্রেসের আগাম জয় ঘোষণা করেছিল! এমন ঘটনা ভারতের রাজনীতির ইতিহাসে ঘটেনি। সব সমীক্ষকের কাছে এটাও এক বড় শিক্ষা।

একই রকমই শিক্ষা দিল জম্মু–কাশ্মীরের ভোট। সেখানেও কোনো সমীক্ষা বা জরিপ বিজেপি অথবা এনসি–কংগ্রেস জোটকে ক্ষমতাসীন হতে দেখেনি। প্রত্যেকেই এক সুরে বলেছিল, এবারেও ঝুলন্ত বিধানসভা হতে চলেছে। দেখার বিষয় ছিল একটাই, সংখ্যাগরিষ্ঠতা কারা পায়, বিজেপি না এনসি-কংগ্রেস। শেষ বেলায় বাজি জিতল ফারুক আবদুল্লাহ–ওমর আবদুল্লাহর দল। যদিও সেই জয় তাঁদের শাসনের পূর্ণ ক্ষমতা কতটা দেবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সংশয় বাড়িয়ে তুলেছে দিল্লির রাজনীতি, কেন্দ্রীয় ইশারায় যা পরিচালনা করছেন অনির্বাচিত উপরাজ্যপাল।

জম্মু–কাশ্মীরের এবারের ভোট প্রমাণ করল, সমাজ যতই আলোড়িত হোক, উপত্যকার মানুষ এখনো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কোল পেতে দেয়নি। ইঞ্জিনিয়ার রশিদ লোকসভা ভোটে ওমর আবদুল্লাহকে হারিয়ে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। তিনি এতটাই উৎফুল্ল ও আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন যে রাতারাতি দল গড়ে ৩৬ কেন্দ্রে প্রার্থী দিলেন। ভোটের ফলে দেখা যাচ্ছে, ৩১ জনের জামানত জব্দ হয়েছে। ৯ জন পেয়েছেন এক হাজারের কম ভোট। জিতেছেন মাত্র একজন।

রশিদকে নিয়ে বিজেপির উৎসাহের অন্ত ছিল না। এতটাই যে কেন্দ্রের ইশারায় নির্বাচনে প্রচারের জন্য তাঁকে জামিন পর্যন্ত দেওয়া হয়। শুধু তা–ই নয়, নিষিদ্ধ জামায়াতে ইসলামিকে মদদ দেওয়া হয় স্বতন্ত্র হিসেবে প্রার্থী দিতে। উপত্যকায় বিজেপি এবার এনসি–কংগ্রেস–সিপিএম জোটকে হারাতে অঘোষিত এক ফ্রন্ট খুলেছিল। সেখানে ছিল তাদের মদদে তৈরি দুই দল—গুলাম নবি আজাদের ‘আজাদ পার্টি’ ও আলতাফ বুখারির ‘আপনি পার্টি’, রশিদের দল ‘আওয়ামি ইত্তেহাদ পার্টি’ (এআইপি) এবং জামায়াতের স্বতন্ত্ররা।

নির্বাচনে এআইপি ও জামায়াত জোটও বেঁধেছিল। জামায়াত দিয়েছিল ১০ প্রার্থী। তাঁদের মধ্যে ৮ জনের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। একজনমাত্র কিছুটা প্রতিরোধ গড়েছিলেন। সায়র আহমেদ রেসি। কুলগামে ২৫ হাজার ভোট পেলেও তিনি হারেন সিপিএমের প্রবীণ নেতা ইউসুফ তারিগামির কাছে—আট হাজারের বেশি ভোটে। পার্লামেন্ট হামলার মূল পরিকল্পনাকারী বলে চিহ্নিত আফজল গুরুর ভাই আইজাজ আহমেদ গুরু সোপোর থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি পেয়েছেন মাত্র ১২৯টি ভোট।

লোকসভা নির্বাচনে দুই লাখের বেশি ভোটে জেতা রশিদের হাল কেন এমন হলো? এর একটি ব্যাখ্যা সেই সময় তাঁর ছেলেদের প্রচার ও সহানুভূতি। বন্দী রশিদের যেকোনো দিন মৃত্যু হতে পারে, এমন একটা প্রচার সেই সময় ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু জয়ের পর জামিনে মুক্তি পাওয়া, এতজনকে প্রার্থী করা এবং জামায়াতের সঙ্গে হাত মেলানো যে প্রচারের সুযোগ করে দেয়, তার মোকাবিলা তিনি ও তাঁর দলের প্রার্থীরা করতে পারেননি। উপত্যকাবাসীর কাছে রশিদ, জামায়াতে ইসলামি, গুলাম নবি আজাদ, আলতাফ বুখারি—প্রত্যেকেই বিজেপির ‘বি–টিম’ বলে পরিচিত পেয়েছে। বিজেপির এই পরোক্ষ আগ্রাসন উপত্যকা মেনে নেয়নি। তারা ঢেলে সমর্থন জানিয়েছে পুরোনো পরিচিত আবদুল্লাহ পরিবার পরিচালিত এনসিকে।

এই নির্বাচন ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজের বিরুদ্ধে গণভোটেও রূপ নিয়েছিল। মানুষ যে বিজেপির ওই একতরফা সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি, তা–ও ভোটের ফলে প্রমাণিত। শুধু তা–ই নয়, সেই বিজেপির দোসর হওয়ার কারণে উপত্যকাবাসী এবার মুফতি পরিবার ও তাদের দল পিডিপিকেও রেয়াত করেনি। ২০১৪ সালের বিধানসভা ভোটে যারা ২৮টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয়েছিল, বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গড়া তাদের কতখানি কাল হয়েছে, এবারের ফল তার প্রমাণ। মাত্র তিনটি আসন জিতে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে মেহবুবা মুফতিকে। কন্যা ইলতিজার ভোটে দাঁড়ানোর হাতেখড়িও সফল হলো না। গণনার মাঝপথেই তিনি হার স্বীকার করে নিতে বাধ্য হন।

প্রশ্ন হলো কত দ্রুত জম্মু–কাশ্মীর পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা ফিরে পাবে? বিজেপি যাঁকে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিল, সেই রাম মাধব জানিয়েছেন, পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা অবশ্যই ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু তার আগে যাঁরা ক্ষমতায় আসছেন, কেন্দ্রীয় সরকারকে তাঁদের নিশ্চয়তা দিতে হবে যে জম্মু–কাশ্মীরের সেই সব ভয়ংকর দিন আর ফিরে আসবে না। নিশ্চয়তা দেওয়া ও তা মেনে নেওয়ার মধ্যে কিন্তু আসমান–জমিন ফারাক রয়েছে। ভাবী মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ ও তাঁর দলের কাছে সেই দূরত্ব ঘোচানোই প্রথম চ্যালেঞ্জ।