মঙ্গলবার রাত প্রায় আটটা। উত্তরাখন্ডের উত্তরকাশীর অবরুদ্ধ সুড়ঙ্গ থেকে চাকাযুক্ত স্ট্রেচারে করে প্রথম বেরিয়ে এলেন ঝাড়খন্ডের শ্রমিক বিজয় হোরো। মুহূর্তে তাঁকে ঘিরে শুরু হলো বিজয় উল্লাস। মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি তাঁর গলায় পরিয়ে দিলেন উত্তরীয়। সাক্ষী থাকলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সাবেক সেনাপ্রধান ভি কে সিং। তাঁরা বিজয়কে টেনে নিলেন বুকে। গণমাধ্যমে বন্দী হলো সেই ছবি। উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলল গোটা দেশ। টানা ১৭ দিনের অবিরাম পরিশ্রম সফল।
রাত পৌনে নয়টার আগেই একে একে বের করে আনা সম্ভব হয় ৪১ জনকেই। মুখ্যমন্ত্রী ধামিসহ উদ্ধারকারী দলের সবাই জানিয়েছেন, প্রত্যেক শ্রমিকই সুস্থ আছেন। মনোবলও তাঁদের অটুট।
আজ মঙ্গলবার দুপুরেই আশার আলো জাগিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল এই সুড়ঙ্গধস। ১৭ দিন আগে ১২ নভেম্বর সাড়ে ৪ কিলোমিটার সুড়ঙ্গ ধসে পড়ে। তাতে আটকা পড়েন বিভিন্ন রাজ্য থেকে যাওয়া কর্মরত ৪১ শ্রমিক। সেই থেকে দিন–রাত এক করে উদ্ধারকাজে নেমে পড়েছিল বিভিন্ন সংস্থা। বিদেশ থেকে আনা হয়েছিল যন্ত্রাদি। এসেছিলেন এ ধরনের বিপর্যয়ে উদ্ধারকাজ পরিচালনা করা বিশেষজ্ঞরা। সারা দেশের নজর ঘুরে গিয়েছিল হিমালয়ের পাদদেশের এই এলাকায়।
আশা-নিরাশার দোলাচলে থাকা দেশবাসীর কাছে বিরাট দুঃসংবাদ হয়ে এসেছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা অগার ড্রিলিং মেশিনের অকার্যকর হয়ে পড়ার খবর। বিদেশি বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, নতুন উপায়ে উদ্ধার পর্ব শেষ হতে হতে বড়দিন এসে যাবে। অথচ অসাধ্য সাধন হলো দুই দিনের মধ্যেই। দেশের শ্রমিকেরা শাবল, গাঁইতি দিয়ে হাতে হাতে সুড়ঙ্গ সাফ করে বসিয়ে দিলেন আড়াই ফুট ব্যাসার্ধের কংক্রিটের পাইপ। তার মধ্যে বসানো হলো লোহার পাইপ। সেই পাইপের মধ্য দিয়ে সন্ধ্যার আগে অবরুদ্ধ শ্রমিকদের কাছে পৌঁছে গেলেন বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর জওয়ানরা। তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী হুইল স্ট্রেচারে চাপিয়ে একে একে টেনে টেনে বের করে আনা হলো আটক শ্রমিকদের। সফল হলো গোটা দেশবাসীর প্রার্থনা।
উদ্ধার হওয়া শ্রমিকদের প্রথমেই নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় হাসপাতালে। সেখানে বিশেষ ওয়ার্ড খোলা হয়েছে। রাখা হয়েছে সব ধরনের চিকিৎসাব্যবস্থা। জেলা হাসপাতালের পাশেই তৈরি করা হয়েছে এক হেলিপ্যাড, যাতে প্রয়োজনে কোনো শ্রমিককে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া যায় হৃষিকেশে অবস্থিত অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেসে।
উদ্ধার পর্ব সুষ্ঠুভাবে সমাধার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক বার্তায় বলেন, ‘এই উদ্ধার পর্ব দেশের প্রত্যেক মানুষকে ভাবাবেগে তাড়িত করেছে। আটক থাকা বন্ধুদের বলতে চাই, আপনাদের ধৈর্য ও সাহস আমাদের প্রত্যেককে অনুপ্রাণিত করেছে। দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে তাঁরা পরিবারের সঙ্গে মিলিত হবেন, এটা প্রবল স্বস্তিদায়ক। এই কঠিন সময়ে তাঁদের পরিবার যে ধৈর্য ও সাহস দেখিয়েছে, তা অতুলনীয়।’
কেন্দ্রীয় সড়ক উন্নয়নমন্ত্রী নিতিন গড়কড়ি জানিয়েছেন, দেশের সব নির্মীয়মাণ সুড়ঙ্গের হাল খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এ বিপর্যয় থেকে দেশ অনেক কিছু শিখল।
শেখা গেল এই সত্যও, যন্ত্র যেখানে ব্যর্থ, সেখানে অভাবনীয় সাফল্য এনে দিলেন ভারতের অখ্যাত শ্রমিকেরা। বিরূপ পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা হাতে করে সুড়ঙ্গের ধস সরিয়ে পাইপ বসানোর মতো অসাধ্য সাধন করতে পেরেছেন।
উদ্ধারকাজ সমাধান হওয়া সত্ত্বেও বৃহত্তর প্রশ্নটি কিন্তু জেগে থাকছে। প্রকৃতি ধ্বংস করে উন্নয়নযজ্ঞ কতটা যুক্তিযুক্ত, সেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে দেশবাসীকে। যে সুড়ঙ্গধস এত শ্রমিককে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল, তা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাধের ‘চার ধাম’ প্রকল্পের অঙ্গ। উত্তরাখন্ডে ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের জন্য সর্ব ঋতুর সড়ক তৈরি ও প্রচলিত সড়ক চওড়ার মাধ্যমে রাজ্যের চার প্রধান তীর্থক্ষেত্র কেদারনাথ, বদ্রিধাম, গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রীকে জোড়াই এই প্রকল্পের লক্ষ্য। কিন্তু তা করতে গিয়ে প্রকৃতির রোষের মোকাবিলা দেশবাসীকে যে করতে হতে পারে, এই ধস সেই ইঙ্গিত দিয়ে গেল।