গর্ভপাত অধিকার আইন বাতিল করে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের বিতর্কিত আদেশের কয়েক মাস পরই ভারতে একই ইস্যু নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠল। ভারতে গর্ভপাত আইন নিয়ে আদালত কেন এমন রায় দিলেন এবং এই রায়ের তাৎপর্য বিবিসির এক বিশ্লেষণে তুলে ধরা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়ে বলা হয়, দেশের সব নারী গর্ভপাতের অধিকারী। অবিবাহিত নারীরাও ২০ থেকে ২৪ সপ্তাহের গর্ভপাতের অধিকারী। গর্ভপাতের ক্ষেত্রে কে বিবাহিত কে নন, সেই প্রশ্ন অবান্তরই শুধু নয়, অসাংবিধানিকও।
গর্ভপাত অধিকার আইন বাতিল করে মার্কিন আদালতের রায়ে নারীদের অধিকার কয়েক ধাপ পিছিয়েছে বলে সমালোচনা হয়েছে। আর অন্যদিকে ভারতের আদালতের রায়কে ঐতিহাসিক ও নারী অধিকার আন্দোলনের পথে এক ধাপ অগ্রগতি বলে মনে করা হচ্ছে।
২৫ বছরের অন্তঃসত্ত্বা এক নারীর আবেদন থেকেই গর্ভপাতের অধিকার ফিরে পেলেন ভারতের নারীরা। গত জুলাই মাসে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে ২৫ বছরের একা একজন নারী গর্ভপাতের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন।
২৫ বছরের ওই নারী গর্ভপাতের জন্য অনুমতি চেয়ে প্রথমে আবেদন করেন দিল্লি হাইকোর্টে। দিল্লির আদালত আবেদন নাকচ করে দেওয়ার পর তিনি সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন।
সর্বোচ্চ আদালতে নিজের আবেদনের পক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরেন ২৫ বছরের ওই নারী। তিনি বলেন, সঙ্গী বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় তিনি গর্ভপাত চেয়েছিলেন। বিয়ে না করে সন্তান নিলে সামাজিকভাবে হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা থেকেই গর্ভপাত করাতে চান ওই নারী।
আদালতে ওই নারী গর্ভপাতের সপক্ষে আরও বলেন, তিনি কোনো চাকরি করেন না। তাঁর পরিবারও বিত্তবান নয়। ফলে সন্তানের ভরণপোষণ করার মতো আর্থিক সচ্ছলতা তাঁর নেই। সন্তানকে লালনপালন করার জন্য মানসিকভাবে ওই নারী প্রস্তুত নন।
১৯৭১ সাল থেকেই ভারতে গর্ভপাত বৈধ। তবে কয়েক বছর পর দেশটির সরকার কে, কোন অবস্থায় গর্ভপাত ঘটাতে পারে, তা নিয়ে কঠোর বিধিনিষেধ জারি করে। এমন সিদ্ধান্তের পেছনে কারণও ছিল। ভারতীয় সমাজে ছেলেসন্তানের প্রতি মা-বাবার আগ্রহ বেশি থাকায় লাখ লাখ কন্যাসন্তানের ভ্রূণের গর্ভপাত করা হয়। ফলে দেশটিতে নারী ও পুরুষের অনুপাতে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়।
গর্ভপাত নিয়ে ভারতে এত কঠোর বিধি জারি করা হয় যে শিশুসহ ধর্ষণের শিকার নারীরা অন্তঃসত্ত্বা হলেও গর্ভপাতের জন্য তাঁদের আদালত থেকে অনুমতি নিতে হতো।
এ ধরনের বেশ কিছু ঘটনার পর ভারত সরকার গত বছর মেডিকেল টার্মিনেশন অব প্রেগন্যান্সি অ্যাক্টের (এমটিপি) সংশোধন করে। সংশোধিত এই অ্যাক্ট অনুসারে গর্ভধারণের ২০ থেকে ২৪ সপ্তাহে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে নারীদের গর্ভপাতের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ধর্ষণের শিকার, কম বয়সী, মানসিকভাবে অসুস্থ, জরায়ুর বড় ধরনের অস্বাভাবিকতা রয়েছে, এমন অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বিচ্ছেদের শিকার অথবা বিধবাদের এ ধরনের সুযোগ দেওয়া হয়।
২৫ বছরের ওই নারীর ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো প্রযোজ্য না হওয়ায় দিল্লি হাইকোর্ট তাঁর গর্ভপাতের আবেদন নাকচ করে দেন। আদালত বলেছিলেন, ওই নারী অবিবাহিত এবং তাঁর যৌনজীবন ছিল। এর কিছুদিন পরে ওই নারী হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন। সেখানে তাঁকে গর্ভপাতের অনুমতি দেওয়া হয়।
আদালতে বেশ কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন ২৫ বছরের ওই নারী। তিনি বলেছেন, মেডিকেল টার্মিনেশন অব প্রেগনেন্সি অ্যাক্টের আইন তাঁর সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করেছে। এই আইনে অবিবাহিত নারীদের গর্ভপাতের অধিকার না দেওয়ার যে বিধি রয়েছে, তা স্বেচ্ছাচারী ও বৈষম্যমূলক।
বৃহস্পতিবারের আদেশে বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি জে বি পর্দিওয়ালা ও বিচারপতি এ এস বোপান্না বলেছেন, বৈবাহিক অবস্থার কারণে একজন নারী অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ না করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন না।
বিচারকদের ওই বেঞ্চ আরও বলেছেন, অবিবাহিত নারীকে গর্ভধারণ করতে বাধ্য করার অর্থ হলো শরীর নিয়ে তাঁর অধিকারকে হরণ করা। অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের কারণে ওই নারীর শিক্ষা, কর্মজীবন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাঁর মানসিক চাপও বাড়তে পারে।
আদালত আরও বলেছেন, গর্ভপাতের অনুমতি না দেওয়া হলে একা নারী অনিরাপদ গর্ভপাত বেছে নিতে পারেন। ভারতে অনেক নারীর এ কারণে মৃত্যু হতে পারে। জাতিসংঘের পপুলেশন ফান্ড বলছে, অনিরাপদ গর্ভপাতের কারণে ভারতে দিনে গড়ে আটজন নারীর মৃত্যু হয়।
ভারতজুড়ে নারী অধিকারকর্মীরা এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, গর্ভপাতের ক্ষেত্রে সব নারীকে সমান অধিকার দিয়ে আদালত এটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে একা নারীরও যৌন সম্পর্ক থাকতে পারে। ভারতের মতো পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এটি ব্যতিক্রমী ধারণা। কারণ, ভারতে বিয়ের আগে যৌন সম্পর্কের বিষয়টি ভালো চোখে দেখা হয় না। এমনকি বিয়ের রাতে নারীদের কুমারীত্ব পরীক্ষারও ব্যবস্থা আছে।
২০১১ সালের সর্বশেষ জরিপ বলছে, ভারতে ৭ কোটি ৩০ লাখ একা নারী রয়েছেন। বিচারপতিরা বলছেন, বছরের পর বছর ভারতীয় সমাজে বদল এসেছে। বিয়ে ছাড়াই একসঙ্গে বসবাস, বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ক, সমকামীদের যৌন সম্পর্কের মতো বিষয়গুলো এখন সমাজে প্রচলিত। সমাজে এসব বদলের কারণে গর্ভপাতসংক্রান্ত আইনে পরিবর্তন আনাটা জরুরি ছিল, বলেছেন বিচারপতিরা।
আরও একটি কারণে ভারতের আদালতের এই রায় আলোচনায় এসেছে। প্রাচীন ঔপনিবেশিক আইন অনুসারে ভারতে একজন পুরুষ তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে এবং স্ত্রী অপ্রাপ্তবয়স্ক না হলে তা ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা হয় না। বৈবাহিক ধর্ষণ বিষয়ে এক আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টে বিষয়টির ওপর শুনানি চলছে।
বিচারপতিরা বলছেন, তাঁদের নির্দেশ বৈবাহিক ধর্ষণের বৈধতার বিষয়ে নয়। তবে আদালত বলছেন, যদি স্বামীর ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের কারণে স্ত্রী অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ করেন, তাহলে তিনি গর্ভপাত করাতে পারবেন।