‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি বাস্তবায়নের আগে কী জম্মু-কাশ্মীরে ভোট হবে

রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার পর সত্যিই কি কাশ্মীর পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

জম্মু-কাশ্মীর শিগগিরই যে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা ফিরে পাচ্ছে না, সেটা স্পষ্ট। কিন্তু সেখানকার বিধানসভার নির্বাচনও দ্রুত হবে কি না, সে বিষয়ে এখন ঘোরতর সন্দেহ দেখা দিয়েছে। খোদ কেন্দ্রীয় সরকারই সেই সংশয় সৃষ্টির কারণ। সরকার ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি বাস্তবায়নে যেভাবে আগ্রহ দেখাচ্ছে, তাতে সেই সংশয় বেড়ে গেছে।

জম্মু-কাশ্মীরের পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা ফেরানোর বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা দেওয়া সম্ভব নয়, সে কথা গত ৩১ আগস্ট কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টকে স্পষ্ট জানিয়েছিল। সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন সাংবিধানিক বেঞ্চকে বলেছিলেন, উপদ্রুত ওই সাবেক রাজ্যকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হয়েছিল অনেক ভাবনাচিন্তার পর। দেশের নিরাপত্তা রক্ষাই ছিল তার প্রধান কারণ। তবে সেই সিদ্ধান্ত অবশ্যই সাময়িক।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নিজেই সংসদে এমন কথা জানিয়েছিলেন। অবস্থা অনেকটাই শুধরেছে; কিন্তু পুরোপুরি নয়। সেই অবস্থায় পৌঁছতে হলে জম্মু-কাশ্মীরকে আরও কিছুকাল কেন্দ্রশাসিত থাকতে হবে। তুষার মেহতা বলেছিলেন, তবে ওই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে এখনই নির্বাচন করতে সরকার প্রস্তুত।

কবে, কীভাবে নির্বাচন করবে, সে সিদ্ধান্ত নেবে অবশ্য কেন্দ্র ও রাজ্যের নির্বাচন কমিশন।

তুষার মেহতা বলেছিলেন, সরকার এখনই নির্বাচন করতে প্রস্তুত। পঞ্চায়েত, পৌরসভা ও বিধানসভার ভোট করাতে কোনো অসুবিধা নেই। রাজ্যের ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ প্রায় শেষ। কেন্দ্র বিভাজনও হয়ে গিয়েছে।

কেন্দ্রীয় সরকারের ওই আশ্বাস দুই দিন পরই সংশয়ে পরিণত হয় ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতির দরুন। কেন্দ্রীয় সরকার ওই নীতি বাস্তবায়নে ২ সেপ্টেম্বর এক উচ্চপদস্থ কমিটি গঠন করে। সেই কমিটির নেতৃত্বে রাখা হয়েছে দেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দকে, যিনি রাষ্ট্রপতি থাকাকালেই দেশের লোকসভা ও বিধানসভার ভোট একসঙ্গে করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

আটজনের ওই কমিটিতে লোকসভার বিরোধী নেতা কংগ্রেস সদস্য অধীর রঞ্জন চৌধুরীর নাম রাখা হয়েছিল। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, প্রথমত, তাঁকে জিজ্ঞাসা না করেই নাম ঢোকানো হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, রাজ্যসভার বিরোধী নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গেকে না রেখে কমিটিতে মনোনীত করা হয়েছে রাজ্যসভার সাবেক বিরোধী নেতা গুলাম নবী আজাদকে। তৃতীয়ত, স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে, কমিটির বিবেচ্য বিষয়ে সরকার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। তারা চায় কমিটি শুধু সিদ্ধান্তে সিলমোহর দিক।

সংগত কারণেই বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, যে সরকার সারা দেশে একযোগে ভোট করাতে আগ্রহী, যে উদ্দেশ্যে সাবেক রাষ্ট্রপতিকে চেয়ারম্যান করে গুরুত্বপূর্ণ কমিটি করা হয়েছে, যে কাজ সরকার আর কালক্ষেপ না করে দ্রুত সেরে ফেলতে চাইছে, সেই কাজ শুরু ও শেষের আগে কি সরকার জম্মু-কাশ্মীরের ভোট করাতে আগ্রহী হবে? বিশেষ করে ওই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের স্থানীয় অধিকাংশ রাজনৈতিক দল যখন কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপির বিরোধী? এবং বিশেষ মর্যাদা রদ, রাজ্য দ্বিখণ্ডিতকরণ এবং পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ (গুপকর অ্যালায়েন্স) হয়েছে?

কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছিল, জম্মু-কাশ্মীরে প্রথমে করা হবে পঞ্চায়েত ও পৌরসভার ভোট।

তারপর বিধানসভার। কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রণালয় ২ সেপ্টেম্বর ‘এক দেশ এক ভোট’ নিয়ে যে গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে, তাতে লোকসভা, বিধানসভা ও পঞ্চায়েত-পৌরসভার ভোট একই সঙ্গে করানোর ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়েছে। সেই লক্ষ্যে সংবিধান, জনপ্রতিনিধিত্ব আইন ও বিভিন্ন বিধিতে কী কী পরিবর্তন আনা প্রয়োজন কিংবা পরিবর্তন না এনে এই কাজ করা সম্ভব কি না—সেসব খতিয়ে দেখার কথা বলা হয়েছে।

কাজেই প্রশ্ন উঠছে, সরকার যখন এতই তৎপর, তখন শুধু জম্মু-কাশ্মীরের জনগণকে তুষ্ট করতে সেখানে আলাদা ভোট করাবে কি? বিশেষ করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটি যখন এখনো উপদ্রুত এবং স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফেরানো নিয়ে সরকার শতভাগ নিশ্চিত নয়? আরও একটি বিষয়, এমনিতেই জম্মু-কাশ্মীরের গণতন্ত্রহীনতার বয়স পাঁচ বছর (এক বছর রাষ্ট্রপতির শাসন) অতিক্রান্ত। সেখানে আরও কিছুকাল অপেক্ষা করলে ক্ষতি কী—সে প্রশ্নও বিভিন্ন মহলে উঠছে।

কেন্দ্রীয় সরকার ১৮ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকেছে। কেন ও কী কারণে ওই সিদ্ধান্ত, বিশেষ অধিবেশনে কী আলোচনা হবে—সে বিষয়ে সরকার এখনো কিছুই জানায়নি।

এর মধ্যেই গঠিত হয়েছে রামনাথ কোবিন্দ কমিটি। ফলে রাজনৈতিক জল্পনার শেষ নেই।

‘এক দেশ এক ভোট’ নীতির প্রবল বিরোধিতা শুরু করেছে বিরোধীরা। ‘ইন্ডিয়া’ জোটের প্রায় সবাই এর বিরোধিতা করছে। কংগ্রেসসহ অন্য সবাই বলছে, এটা দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর আঘাত।

কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেছেন, নরেন্দ্র মোদি গণতান্ত্রিক ভারতকে স্বৈরতান্ত্রিক করে তুলতে চাইছেন। রাহুল বলেছেন, ভারত হলো বিভিন্ন রাজ্যের সমষ্টি। এই নীতি সেটাকেই আঘাত করতে চাইছে।

কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রণালয়ের এক সূত্রের কথায়, এমন ধরনের কোনো নীতি রাতারাতি বাস্তবায়ন করা হয় না। সরকার চাইছে ঐকমত্যে পৌঁছতে। সে লক্ষ্যেই এই প্রচেষ্টা। তবু প্রশ্ন, সেই লক্ষ্য পূরণে এক থেকে দেড় বছর লাগলে সরকার কি সেই সময়ের জন্য জম্মু-কাশ্মীরের ভোট করাতে আগ্রহী হবে?