কলকাতার দুর্গাপূজা তো এক মহোৎসব। এবার সেখানে জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেসকো এই ঐতিহ্যবাহী দুর্গোৎসবকে বিশ্বের ঐতিহ্যের তালিকায় তুলেছে। তাই এই উৎসবের তেজ, আনন্দ বেড়ে গেছে বহুগুণ। কলকাতাসহ গোটা পশ্চিমবঙ্গে উদ্যাপিত হচ্ছে নতুন ভাবনা আর উৎসাহ নিয়ে। চলছে বিভিন্ন পূজা কমিটির মধ্যে মণ্ডপ আর দুর্গাপ্রতিমা নির্মাণে অভিনবত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতা। প্রতিমার নির্মাণশৈলী নিয়ে প্রতিযোগিতা। ভাবনার লড়াই।
এবার কলকাতার ঐতিহ্যবাহী বাগবাজার দুর্গোৎসব কমিটি ১ অক্টোবর সন্ধ্যায় উৎসবের সূচনা করবে আকাশে ৫০০টি কৃত্রিম ড্রোন উড়িয়ে। ওই ড্রোনের সংযুক্ত আলোকচ্ছটায় আকাশে ভেসে উঠবে কখনো দুর্গার মুখ, আবার কখনো দুর্গার পরিবারের অন্যান্য দেবতার মুখ। আর এই বিশেষ ড্রোনের আলোকচ্ছটার জন্য মুম্বাইয়ের একটি কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছে বাগবাজার পূজা কমিটি।
আবার বনগাঁয়ের মৃতপ্রায় ইছামতী নদীর কচুরিপানাকে থিম করে পূজার মণ্ডপ বানিয়েছে ইছামতী শারদোৎসব কমিটি। উত্তর কলকাতার নামী পূজা শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাব এবার থিম করেছে ভ্যাটিকান সিটিকে।
যাত্রাশিল্প ও কলকাতার ট্রামকে বাঁচাতে এবার যাত্রাশিল্প ও ট্রামকে থিম করেছে সোদপুর উদয়ন সংঘ।
আন্দামান ও নিকোবর দীপপুঞ্জের জনজাতি জারোয়াদের জীবনকে থিম করেছে শ্রীরামপুরের বান্ধব সংঘ। তারা তৈরি করেছে একটি জারোয়া গ্রামও। হোল বা ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরকে থিম করেছে খিদিরপুর পল্লি। এই হোলে লুকিয়ে রয়েছে সৃষ্টির আদি রহস্য। আবার মন্দির বাজারের চাঁদপুর সায়ক গোষ্ঠীর থিম এবার তালপাতার অক্ষরজ্ঞান। বাংলা ভাষার সমাদর কমে যাওয়ায় এ থিম এই ক্লাবের। অন্যদিকে অমরনাথ মন্দিরের থিম করেছে দয়ারামপুর বালক সংঘ। তারা প্রতিমা নির্মাণ করেছে আলুর চিপস দিয়ে। ঘাটেশ্বর জাগৃতি সংঘ এবার থিম করেছে টেম্পল অব থাইল্যান্ডের ভাবনায়। আদিবাসীদের দেবতা অসুরকে থিম করেছে কাশীনগর শারদ উদ্যাপন কমিটি। রায়দীঘি বাজার দুর্গোৎসব কমিটি থিম করেছে মৌমাছির দেশে সুতার প্রতিমাকে। পার্ক সার্কাস সর্বজনীন পূজার এবারের থিম মহামিলন। মানুষের সঙ্গে ভেদাভেদ ভুলে মহামিলনের বার্তা দিয়েছে তারা। গড়িয়াহাটের হিন্দুস্থান ক্লাব এবার থিম করেছে এক মিনি ভারতবর্ষকে।
২০১৫ সালে বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রতিমা বানিয়ে তাক লাগিয়েছিল দক্ষিণ কলকাতার দেশপ্রিয় পার্ক। এবার তারা থিম করেছে ফিরে দেখা। রাজবাড়ী নিয়ে। বালিগঞ্জ কালচারালের এবারের থিম চাকা। কর্মকর্তারা বলেছেন, চাকা বিবর্তনের প্রতীক। তাই করোনাকে পরাস্ত করে এগিয়ে যাওয়ার এই চাকা। কলকাতার সল্ট লেক এফডি ক্লাব থিম করেছে শাপমোচনকে। বাঁশ ও পাটের মণ্ডপ করেছে তারা। ডোকরাশিল্পকে ভাবনা করে বাড়ৈপুরের পদ্মপুকুর ক্লাব থিম করেছে এবার। সন্তোষপুর সর্বজনীন থিম করেছে ত্রিকালকে। মানুষের জীবনের তিনকালকে নিয়ে।
যৌনকর্মীদের জীবনের মূলস্রোতে আসার বার্তা নিয়ে মুক্তির স্বাদকে থিম করেছে বরাহনগর সর্বজনীন পূজা কমিটি। আর বরাহনগরের বন্ধুদল স্পোর্টিং ক্লাব থিম করেছে বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণের লীলাক্ষেত্রকে নিয়ে। মণ্ডপ তৈরি হয়েছে বৃন্দাবনের প্রেমমন্দিরের আদলে।
আর হুগলির বৈদ্যবাটির নার্সারি রোড বারোয়ারি পূজা কমটি এবার থিম করেছে মরুভূমির জাহাজ নিয়ে। রাজস্থান থেকে তারা এনেছে দুটি জীবন্ত উট।
আর কলকাতার ঐতিহ্যবাহী কলেজ স্কোয়ার সর্বজনীনের এবারের থিম রাধাকৃষ্ণের প্রেম। মানুষে মানুষে বিভেদ ভুলে গিয়ে ভালোবাসার প্রেমে মজে যাওয়া।
পুরো পশ্চিমবঙ্গে এবার ৪৩ হাজার পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত ১০ বছরে এই রাজ্যে দুর্গাপূজার সংখ্যা ৯১ শতাংশ বেড়েছে। রাজ্য সরকারের হিসাব অনুযায়ী ২০১১ সালে এ রাজ্যে পূজার সংখ্যা ছিল ২০ হাজার ৯৭০। ২০২১ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৪০ হাজার ১২৪। আর এ বছর সেই সংখ্যা আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার। এই ৪৩ হাজার পূজা কমিটিকে রাজ্য সরকার ৬০ হাজার রুপি করে অনুদান দিয়েছে। রাজ্যের বিদ্যুৎ-বিষয়ক মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস গতকাল এ অনুদান দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন।