তবু রাশিয়ার সঙ্গে কেন এত সুসম্পর্ক ভারতের

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন
ফাইল ছবি: এএফপি

ইউক্রেনের ওপর রাশিয়া হামলা করার পর পশ্চিমা বিশ্ব মস্কোর বিরুদ্ধে নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং এখনো করছে। পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলেও ভারত এই নিষেধাজ্ঞায় খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি; বরং রাশিয়া থেকে ভারতের আমদানি অনেক বেড়েছে, বিশেষ করে অপরিশোধিত তেল।

ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২২ সালে ভারত যেসব দেশ বিভিন্ন পণ্য থেকে আমদানি করে, সেই তালিকায় চতুর্থ বৃহত্তম দেশ হয়ে উঠেছে রাশিয়া। ওই বছরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রাশিয়া থেকে ভারতের আমদানির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৪০ কোটি মার্কিন ডলার, ২০২১ সালে একই সময়ে যা ছিল ৬৫৮ কোটি ডলার।

অথচ ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ভারতের শীর্ষ ২৫ ব্যবসায়িক অংশীদারের মধ্যে রাশিয়া ছিল না। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়া থেকে ভারতের তেল আমদানি ব্যাপক হারে বৃদ্ধির পর এ অবস্থা দাঁড়িয়েছে।

ভারতের বাণিজ্যসচিব সুনিল বার্থওয়াল নিক্কেই এশিয়াকে বলেন, ভারত ‘অনেক অপরিশোধিত তেল কিনে সেগুলোকে পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম পণ্যে রূপান্তরিত করে বিক্রি করেছে’।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার আওতায় চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে ভারত এতে লাভবান হয়েছে। ভারত তার চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ তেল আমদানি করে থাকে। রাশিয়ার তেল কেনার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের ওপর ভারতের নির্ভরতা কমেছে। কারণ, আগে ভারতের মোট তেল আমদানির ৬০ শতাংশের উৎস ছিল মধ্যপ্রাচ্য।

শীতল যুদ্ধের সময় অস্ত্র চুক্তি

১৯৫৫ থেকে ১৯৯১ সালের মধ্যে ভারত তার তিন-পঞ্চমাংশ অস্ত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কিনেছে বলে স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা সিপ্রির হিসাব বলছে।

আর যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া এয়ার ইউনিভার্সিটি বলছে, ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে সামরিক সহযোগিতা এখনো অনেক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আছে।

ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য ‘এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা’ কিনতে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেছে ভারত। এই ব্যবস্থা মূলত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলাকে প্রতিরোধ করে। এটি আধুনিক ও মোক্ষম আকাশ প্রতিরক্ষা হিসেবে বেশ স্বীকৃত। মূলত, চীন ও পাকিস্তান থেকে এমন হামলা হলে তা প্রতিরোধ করতে এই আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কিনছে ভারত। এমনকি এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দিয়ে অনেক দূরে থাকা যুদ্ধবিমানও ধ্বংস করে দেওয়া যাবে।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফরের সময় ওই চুক্তি হয়। তখন পুতিন ও মোদি এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছিলেন, রাশিয়া-ভারত সম্পর্ক ক্রমে আরও শক্তিশালী হচ্ছে।

এ ছাড়া রাশিয়া থেকে ‘ক্রিভেক ক্লাস-ফ্রিগেট’ কেনার পরিকল্পনা করছে ভারত। এর মধ্যে দুটি জাহাজ গোয়ার শিপইয়ার্ডে জোড়া দেওয়া হবে এবং বাকি দুটি একেবারে তৈরি অবস্থায় রাশিয়া থেকে আনা হবে।

তবে ভারতের প্রতিবেশী চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের সমরাস্ত্র আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। চীন থেকেও অবশ্য অস্ত্র কিনে থাকে পাকিস্তান।

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা কি আছে

সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে ভারতকে সতর্ক করে বলা হয়েছিল, যেসব দেশ রাশিয়ার কাছ থেকে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও গোয়েন্দা সমরাস্ত্র কিনবে, সেসব দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য ট্রাম্প প্রশাসন সিএএটিএসএ আইনও অনুমোদন করেছিল।

রাশিয়ার কাছ থেকে ‘এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা’ কেনার পর চীনের সামরিক বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে ভারত আশা করছে, মিত্রদেশ হিসেবে তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র এমন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে না। তবে তৎকালীন ট্রাম্প প্রশাসন বা বর্তমান বাইডেন প্রশাসন এখনো এমন কোনো ইঙ্গিত দেয়নি।

অর্থনীতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নকে অনুসরণ

একটা সময় সোভিয়েত ঘরানার অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ছিল ভারতের অর্থনীতির মডেল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ভারত অর্থনীতিতে সংস্কার এনে মুক্ত অর্থনীতির যুগে প্রবেশ করে।

বড় শক্তি হওয়ার ইচ্ছা

২০০৫ সালে জর্জ ডব্লিউ বুশের সময় মার্কিন প্রতিনিধিরা বলা শুরু করেন, ভারত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রাকৃতিক মিত্র’। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পেলে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশ ‘একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বের একটি বড় শক্তিতে’ পরিণত হতে পারে। এমন শক্তিতে পরিণত হওয়ার আশা থেকেই ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অংশীদারত্বের পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা এসসিও, ব্রিকস এবং রাশিয়া-ভারত-চীন বা আরআইসি গ্রুপে আছে।

গত সেপ্টেম্বরে মার্কিন থিঙ্কট্যাংক কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের রাজন মেনন ও ইউজেন রুমার লিখেছিলেন, রাশিয়া-ভারতের অংশীদারত্ব চলতে থাকবে। তাঁরা মনে করেন, ভারতের কাছে এখনো অস্ত্র পাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ উৎস রাশিয়া। রাশিয়ার বিরুদ্ধে দেওয়া পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় ভারত অংশ নেয়নি। এর মাধ্যমে ভারতে দেখিয়ে দিতে চায়, পররাষ্ট্রনীতিতে তারা স্বাধীন।