প্রত্যাশামতো আফ্রিকার দেশ নামিবিয়া থেকে আটটি চিতা ভারতে এল। আজ শনিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সেই চিতাগুলোর মধ্যে তিনটিকে মধ্যপ্রদেশের কুনো জাতীয় অভয়ারণ্যে খাঁচা থেকে মুক্ত করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এ কাজ তিনি করলেন তাঁর ৭২তম জন্মদিনে।
খাঁচা থেকে চিতা অবমুক্ত করে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, ‘এই চিতাগুলো আমাদের অতিথি। আমাদের কর্তব্য কুনোকে সেগুলোর ঘরবাড়ি করে তোলা।’
নামিবিয়া থেকে একটি বিশেষ বিমান চিতাগুলোর খাঁচা নিয়ে মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র বিমানবন্দরে নামে আজ সকালে। সেই বিমানে অন্যদের সঙ্গে ছিলেন নামিবিয়ার চিতাবিশেষজ্ঞেরা। উড়ালের সময় চিতাগুলোকে অভুক্ত রাখা হয়েছিল। হালকা ঘুমের ওষুধ দিয়ে সেগুলোকে কিছুটা আচ্ছন্নও রাখা হয়েছিল। গোয়ালিয়রে প্রস্তুত ছিল ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিশেষ হেলিকপ্টার ‘চিনুক’। দুটি হেলিকপ্টারে চিতাগুলোর খাঁচা তুলে নিয়ে যাওয়া হয় পৌনে ২০০ কিলোমিটার দূরে কুনো অভয়ারণ্যে। সেখানে দুটি জায়গায় প্রধানমন্ত্রী তিনটি চিতাকে খাঁচা থেকে মুক্তি দেন।
চিতা মুক্তির সময় প্রধানমন্ত্রী হালকা তুঁত রঙের কুর্তার ওপরে পরেছিলেন একটা জ্যাকেট। মাথায় ছিল ‘হ্যাট’। চোখে রঙিন রোদচশমা। তাঁর সঙ্গী ছিলেন বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান।
ভারতে চিতার প্রত্যাবর্তন ঘটল দ্রুততম এই পশুর লুপ্ত হওয়ার ৭৫ বছর পর। ১৯৪৭ সালে মধ্য ভারতের সরগুজা স্টেটের (বর্তমানে ছত্তিশগড় রাজ্যের অধীন) তৎকালীন রাজা রামানুজ প্রতাপ সিং দেও শেষ তিনটি চিতা শিকার করেছিলেন। এর পর থেকে দেশের কোথাও কখনো চিতার সন্ধান পাওয়া যায়নি। ১৯৫২ সালে ভারত সরকার দেশকে চিতাশূন্য ঘোষণা করেছিল। তৎকালীন ভারতীয় চিতাগুলো ছিল এশীয় প্রজাতির। এশিয়াটিক চিতা এখন রয়েছে এক মাত্র ইরানে। আজ যে আটটি চিতা ভারতে এল, সেগুলো সবই আফ্রিকা প্রজাতির। তবে এই চিতাগুলো এখনই সাধারণ মানুষ দেখতে পাবে না। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে সে কথা জানিয়ে বলেছেন, এই চিতাগুলোকে নতুন পরিবেশে সড়গড় হওয়ার জন্য কিছুটা সময় দিতে হবে। তারপর কুনো অভয়ারণ্যের এই অংশ পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হবে। পেশাদার ফটোগ্রাফাররা যে ধরনের ক্যামেরায় বন্য প্রাণীর ছবি তোলেন, সে রকম ক্যামেরায় প্রধানমন্ত্রীকে খাঁচামুক্ত চিতাগুলোর ছবি তুলতেও দেখা যায়। সরকারিভাবে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, নতুন পরিবেশ দেখে চিতাগুলো বিহ্বল। যেন বুঝতে চাইছে, চেনা পরিবেশ ছেড়ে কোথায় সেগুলোকে নিয়ে আসা হয়েছে।
সরকারিভাবে বলা হয়েছে, মোট আটটি চিতার মধ্যে পাঁচটি নারী। সেগুলোর বয়স দুই থেকে পাঁচ বছর। তিনটি পুরুষ চিতার বয়স সাড়ে চার থেকে সাড়ে পাঁচ বছর। আটটি চিতার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে ছয়টি এলাকা। একেকটি এলাকার আয়তন কমবেশি ১৫০ বর্গমিটার। প্রাথমিকভাবে সেখানে সেগুলোকে রাখা হচ্ছে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য। প্রতিটি চিতার শরীরে রয়েছে রেডিও কলার। একেকটি চিতার জন্য নিযুক্ত আছেন একজন বিশেষজ্ঞ। পরীক্ষামূলক সময় ঠিকমতো কেটে গেলে চিতাগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হবে ৭৪০ বর্গকিলোমিটার অভয়ারণ্যে।
দেশে চিতার প্রত্যাবর্তনের ঘটনার সঙ্গে আপাতদৃষ্টে রাজনৈতিক লাভ–লোকসানের কোনো সম্পর্ক নেই জানিয়েও এই উপলক্ষের রাজনীতিকীকরণে প্রধানমন্ত্রী বিরত থাকেননি, তা নিয়ে রাজনীতির তরজাও শুরু হয়ে গেছে। চিতা পাঠানোর জন্য নামিবিয়া সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেন, দুঃখের কথা, গত ৭০ বছরে চিতার প্রত্যাবর্তনে সে রকম কোনো উদ্যোগ কেউ নেয়নি। ‘প্রজেক্ট চিতা’ শুরু তাঁর সরকারের আমলেই।
কংগ্রেস সঙ্গে সঙ্গেই এই দাবির তীব্র বিরোধিতা করেছে। কংগ্রেস মুখপাত্র জয়রাম রমেশ টুইট করে বলেছেন, মনমোহন সিং সরকারের সময়েই ২০০৮–০৯ সালে প্রজেক্ট চিতা শুরু হয়েছিল। বন ও পরিবেশমন্ত্রী হিসেবে জয়রাম ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘চিতা আউটরিচ সেন্টার’এ–ও গিয়েছিলেন। সেই ছবিও কংগ্রেসের তরফে প্রকাশ করা হয়। বলা হয়, বিদেশ থেকে দেশে চিতা আনার পরিকল্পনার ওপরে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৩ সালে স্থগিতাদেশ দিয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট সেই স্থগিতাদেশ তোলেন ২০২০ সালে।
ভারতে চিতা প্রত্যাবর্তনের প্রথম উদ্যোগ অবশ্য গৃহীত হয়েছিল সত্তরের দশকে। সে সময় কথাবার্তা চালানো হয়েছিল ইরানের সঙ্গে। এশিয়াটিক চিতা আমদানি নিয়ে। নতুন শতাব্দীতে ইরান ভারতের এশিয়াটিক সিংহের বদলে সে দেশের এশিয়াটিক চিতা দিতে রাজিও হয়েছিল। কিন্তু বাধা দিয়েছিলের তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি কুনো অভয়ারণ্যে এশিয়াটিক সিংহের পুনর্বাসনের উদ্যোগেও বাধা দিয়েছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল, সিংহ গুজরাটের ‘আইকন’। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের জন্মদিনে সেই কুনোতেই তিনি চিতার প্রত্যাবর্তন ঘটালেন।