‘কাশ্মীর ফাইলস’ নিয়ে ভারতে আবার বিতর্ক

‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ চলচ্চিত্রের পোস্টার  
ছবি: সংগৃহীত

কাশ্মীর নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্র ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ নিয়ে ভারতে নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এর সূত্রপাত ইসরায়েলি পরিচালক নাদাভ লাপিদের বক্তব্য কেন্দ্র করে। সম্প্রতি ভারতের আন্তর্জাতিক গোয়া চলচ্চিত্র উৎসবে প্রধান বিচারক ছিলেন ইসরায়েলি এই পরিচালক। এ সময় তিনি বলেছেন, ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ একটি প্রচারমূলক, কুরুচিপূর্ণ চলচ্চিত্র, যা মর্যাদাপূর্ণ একটি চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিযোগিতা বিভাগে দেখানো উচিত হয়নি।

এর প্রতিক্রিয়ায় চলচ্চিত্রটির অভিনেতা, অভিনেত্রী ও হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন সংগঠন পরিচালক নাদাভ লাপিদ ও ইসরায়েলকে সামাজিক মাধ্যমে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেছেন।

আমরা সবাই চলচ্চিত্র উৎসবের পঞ্চদশ ছবি ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ দেখে বিরক্ত ও বিস্মিত। এটিকে দেখে একটি প্রচারমূলক, কুরুচিপূর্ণ চলচ্চিত্র বলে মনে হয়েছে।
নাদাভ লাপিদ, ইসরায়েলি পরিচালক।

চলতি বছরের মার্চ মাসে ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ চলচ্চিত্রটি ভারতে মুক্তি পায়। এই চলচ্চিত্রে দেখানো হয় নব্বইয়ের দশকে কাশ্মীরে কীভাবে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের ওপর আক্রমণ নেমে আসে। চলচ্চিত্রটিতে সরাসরি বলা হয়, এই আক্রমণের জন্য কাশ্মীরের মুসলমান সমাজ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতৃত্ব দায়ী; যারা সংগঠিতভাবে হিন্দুদের আক্রমণ ও হত্যা করে তাদের কাশ্মীর ছাড়তে বাধ্য করে।

যাঁরা চলচ্চিত্রটি দেখেছেন, তাঁদের অনেকের অভিযোগ, চলচ্চিত্রের এই তথ্য আংশিকভাবে সঠিক হলেও এর প্রেক্ষাপট ও সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত কত সংখ্যক কাশ্মীরি মুসলমান সেখানে সশস্ত্র বাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন, ঘরছাড়া হয়েছেন বা জেলে রয়েছেন, সে সম্পর্কে চলচ্চিত্রটিতে কোনো আলোকপাত করা হয়নি। অর্থাৎ বহু পুরোনো কাশ্মীর সংঘাতকে একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হলেও চলচ্চিত্রটি পুরোপুরিভাবে একটি নির্দিষ্ট পক্ষের হয়ে বানানো হয়েছে।

তবে লাপিদের এমন বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছেন ভারতে নিযুক্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত নাওর গিলন। টুইটারে এক দীর্ঘ বিবৃতিতে গিলন বলেছেন, ‘ভারতীয় সংস্কৃতিতে অতিথিকে সাক্ষাৎ ভগবানরূপে দেখা হয়। সেখানে অতিথি হয়ে এসে আপনি নিজের মর্যাদার অপমান করেছেন। ভারতীয়দের বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও আতিথেয়তাকে মূল্যহীন করে দিয়েছেন। আমি নিজে চলচ্চিত্র–বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছি যে আপনার মন্তব্য অসংবেদনশীল। এই দীর্ঘ সমস্যা সম্পর্কে কোনো রকম গবেষণা ছাড়াই এ মন্তব্য করা হয়েছে।’ চলচ্চিত্র নিয়ে করা মন্তব্যের জন্য লাপিদের লজ্জা পাওয়া উচিত বলেও টুইটারে লিখেছেন গিলন।

ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত দীর্ঘ বিবৃতিতে বারবার তাঁর দেশের চলচ্চিত্র পরিচালককে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, এর ফলে ভারত ও ইসরায়েলের সম্পর্ক প্রভাবিত হতে পারে।

লাপিদকে উদ্দেশ্য করে গিলন বলেছেন, ‘আপনি ইসরায়েলে ফিরে যাবেন এই ভেবে যে আপনি একটি বলিষ্ঠ বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু ইসরায়েলের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা এখানে থাকব। আপনার উচিত ইসরায়েলে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যে আপনার মন্তব্যের কী পরিণতি হয়েছে। আমার নেতৃত্বাধীন (কূটনৈতিক) দলকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোন ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে।’

কেউ কেউ বলেছেন, ভারতের চলচ্চিত্র পরিচালকেরা যে মন্তব্য করতে পারেননি বা করতে ভয় পেয়েছেন, একজন ইসরায়েলি পরিচালক হয়েও তিনি তা করেছেন। অনেকেই তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, যাঁদের মধ্যে বলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী স্বরা ভাস্করও রয়েছেন।

কিন্তু কী এমন কথা বলেছিলেন নাদাভ লাপিদ, যে কারণে ভারতীয়দের পাশাপাশি নিজ দেশের রাষ্ট্রদূতও চটেছেন তাঁর ওপর। নাদাভ লাপিদ বলেছিলেন, ‘আমরা সবাই (বিচারকেরা) চলচ্চিত্র উৎসবের পঞ্চদশ ছবি, “দ্য কাশ্মীর ফাইলস” দেখে বিরক্ত ও বিস্মিত। এটিকে দেখে একটি প্রচারমূলক, কুরুচিপূর্ণ চলচ্চিত্র বলে মনে হয়েছে। একটি মর্যাদাপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিযোগিতামূলক বিভাগে ছবিটির স্থান পাওয়া উচিত হয়নি। আমার এই বক্তব্য আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে আমার দ্বিধা নেই। এই চলচ্চিত্র উৎসবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমরা নিশ্চিতভাবে সমালোচনামূলক আলোচনায় যেতে পারি, যা শিল্প ও জীবনের জন্য জরুরি।’

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নাদাভ লাপিদকে একজন প্রভাবশালী চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে মনে করা হয়। তিনি একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন, যার মধ্যে ২০১৯ সালে বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘গোল্ডেন বেয়ার’ রয়েছে।

‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’–এর অভিনেতা ও নির্মাতারাও লাপিদের এই মন্তব্যের বিরোধিতা করেছেন। এই চলচ্চিত্রের অন্যতম অভিনেতা বলিউড তারকা অনুপম খের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেছেন, ‘মিথ্যা যতই বড় হোক, তা সব সময়ই সত্যের থেকে অনেক নিচে থাকে।’

চলচ্চিত্রটির আরেক অভিনেত্রী পল্লবী যোশী পরিচালক লাপিদকে একজন ‘হলোকাস্ট ডিনায়ার’ বলে চিহ্নিত করেছেন। হলোকাস্ট ডিনায়ার হলেন ১৯৩০-৪০-এর দশকে জার্মানিতে ইহুদি নিধনকে অস্বীকার করেন, এমন ব্যক্তি।

ভারতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হিন্দুত্ববাদীদের বড় অংশ লাপিদের মন্তব্যের বিরোধিতা করলেও অনেকে আবার তাঁর সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, ভারতের চলচ্চিত্র পরিচালকেরা যে মন্তব্য করতে পারেননি বা করতে ভয় পেয়েছেন, একজন ইসরায়েলি পরিচালক হয়েও তিনি তা করেছেন। অনেকেই তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, যাঁদের মধ্যে বলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী স্বরা ভাস্করও রয়েছেন।

তবে চলচ্চিত্র উৎসবের আরেক বিচারক ও পরিচালক সুদীপ্ত সেন বলেছেন, তিনি লাপিদের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। সুদীপ্ত সেনও কিছুদিন আগে হিন্দুত্ববাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত একটি ছবি ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ বানিয়েছিলেন।