ভারতীয় আদালতের রায়ে যে ব্যবস্থা নিষিদ্ধ, সেই ‘র্যাট হোল মাইনিং’ বা ইঁদুরের মতো গর্ত খুঁড়ে ভূগর্ভস্থ কয়লা সংগ্রহের পেশায় থাকা শ্রমিকেরাই মুশকিল আসান হয়ে উদ্ধার করলেন উত্তরকাশীতে সুড়ঙ্গে আটকে থাকা ৪১ শ্রমিককে। পরিহাসের বিষয় এটাই, সেটা হলো পুরোপুরি সরকারি আনুকূল্য ও সহায়তায়।
যন্ত্র যেখানে ব্যর্থ, সেখানে ত্রাতা হয়ে উঠলেন ওই নিষিদ্ধ পেশার সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকেরা। গত সোমবার থেকে হাতে হাতে শাবল, কোদাল, গাঁইতি দিয়ে সুড়ঙ্গধস সরিয়ে গতকাল মঙ্গলবার রাত থেকে তাঁরাই ‘বীর’।
র্যাট হোল মাইনিং প্রধানত মেঘালয় ও পূর্ব ভারতের অন্যত্র অবস্থিত কয়লাখনি এলাকায় এক বহুল প্রচলিত পদ্ধতি। ইঁদুরের মতো গর্ত করে ছোট ছোট সুড়ঙ্গ সৃষ্টির মাধ্যমে এসব এলাকায় শ্রমিকেরা কয়লা উত্তোলন করেন। কাজটি পরিবেশের দিক থেকে ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ বলে ভারতের পরিবেশ আদালত ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল (এনজিটি) ২০১৪ সালে ওই প্রথায় কয়লা খনন নিষিদ্ধ করেন।
এনজিটির মতে, র্যাট হোল মাইনিংয়ের কারণে মাটি, পানি ও বাতাস দূষিত হয়। ছোট ছোট সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে বর্ষায় প্রবাহিত হয়ে মূল খনির নিরাপত্তাব্যবস্থাও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। তা ছাড়া ধস নামার কারণে শ্রমিকদের জীবনও বিপন্ন হয়। সে জন্যই তা নিষিদ্ধ।
অথচ উত্তরাখন্ডের উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গে আটক শ্রমিকদের উদ্ধারে সেই নিষিদ্ধ পেশার শ্রমিকেরাই মুশকিল আসান হয়ে ওঠেন। তাঁদের নিয়োগ করা নিয়ে তাই প্রশ্নও উঠেছিল। জবাবে জাতীয় বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা পর্ষদের সদস্য অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল সৈয়দ আতা হাসনাইন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, র্যাট হোল মাইনিং বেআইনি। কিন্তু সেই শ্রমিকদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো বেআইনি নয়। ওই দক্ষতা কয়লা তোলার ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ; অন্যত্র নয়।
সুড়ঙ্গধস থেকে মুক্ত ৪১ শ্রমিকই সুস্থ আছেন। আজ বুধবার সকালে প্রত্যেকের স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর এ কথা জানিয়েছেন উত্তরাখন্ডের স্বাস্থ্য অধিকর্তা প্রবীণ কুমার। সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, শ্রমিকদের কারও শরীরে বড় ধরনের কোনো অসুখ নেই।
গতকাল রাতেই উদ্ধারের পর পরই শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সেখানে অস্থায়ী ওয়ার্ডে তাঁদের রাখা হয়। আজ নিবিড়ভাবে প্রত্যেকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পর্যবেক্ষণের পর শ্রমিকেরা চাইলে পরিবারের সঙ্গে বাড়ি ফিরে যেতে পারেন।
উত্তরাখন্ড সরকার প্রত্যেক শ্রমিককে এক লাখ রুপি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজ উত্তরাখন্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং দামি ওই ঘোষণার সঙ্গে জানান, শ্রমিকদের ১৫ থেকে ২০ দিনের জন্য ছুটিও মঞ্জুর করা হয়েছে, যাতে তাঁরা বাড়ি যেতে পারেন।
সুড়ঙ্গের অবরুদ্ধ দশা থেকে মুক্তির পর শ্রমিকেরা যেমন অপেক্ষমাণ গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন, তেমনই কথা বলেছেন উদ্ধারকারী দলের সদস্য ও কর্মকর্তারা। আটকে পড়া প্রত্যেক শ্রমিকই জানিয়েছেন, এটা তাঁদের পুনর্জন্ম।
উদ্ধারকাজে জড়িত র্যাট হোল মাইনিংয়ের শ্রমিকেরা বলেছেন, এভাবে তাঁরা কখনো মানুষের প্রাণ বাঁচাবেন, এমনটা জীবনেও ভাবেননি। এটা এক অনির্বচনীয় সুখানুভূতি।
ঝাড়খন্ডের এক শ্রমিক গণমাধ্যমকে বলেছেন, উত্তরকাশীর ওই নির্মাণাধীন সুড়ঙ্গে আটকে পড়ার পর তাঁরা প্রথমে হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। প্রথম ২৪ ঘণ্টা কোনো খাবারও তাঁরা পাননি। তবে তাঁরা ভাগ্যবান, সুড়ঙ্গে বিদ্যুৎ ও পানির সরবরাহের লাইন বিচ্ছিন্ন হয়নি। ২৪ ঘণ্টা পর প্রথম তাঁদের কাছে মুড়ি ও এলাচি পৌঁছানো হয়। তখনই তাঁরা বুঝতে পারেন, তাঁদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
শ্রমিকেরা বলেন, সুড়ঙ্গে আটকে থাকার এই ১৭ দিন তাঁদের কেউ দিনরাতের পার্থক্য বুঝতে পারেননি। মুঠোফোনে লুডো খেলে সময় কাটিয়েছেন। ৪১ জনই এক পরিবারের সদস্য হয়ে গিয়েছিলেন। একে অন্যের সঙ্গে কথা বলে, গল্প করে সময় কাটিয়েছেন। প্রার্থনা ছিল তাঁদের ভরসার বড় স্থল। যত দিন গেছে, সাহায্য যত বেড়েছে, ততই বেড়েছে উদ্ধার পাওয়া নিয়ে তাঁদের বিশ্বাস।
শ্রমিকেরা বলছেন, মুঠোফোনের সংযোগ না থাকায় তাঁরা পরিবারের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন না। তবে চার্জার পাঠানোয় তাঁরা মুঠোফোন চার্জ দিতে পেরেছেন। মুঠোফোনে নানা রকম গেম খেলে তাঁরা সময় কাটিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, উদ্ধারপর্ব শেষ হওয়ার পর সরকার এখন বিপর্যয়ের কারণ খোঁজার দিকে নজর দিচ্ছে। কেন সুড়ঙ্গে ধস নামল, অন্যান্য নির্মাণাধীন সুড়ঙ্গের হালই–বা কেমন, তা খতিয়ে দেখাই এখন সরকারের প্রধান কাজ।