রাহুল গান্ধীর কৃতিত্ব, ১০ বছরে যা কেউ পারেননি, গতকাল সোমবার তিনি তা সম্ভব করলেন। লোকসভার বিরোধী নেতা হিসেবে প্রথম ভাষণেই তিনি বাধ্য করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দু–দুবার উঠে দাঁড়িয়ে জবাব দিতে। শুধু প্রধানমন্ত্রীই নন, মন্ত্রিসভার দুই নম্বর প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংও উঠলেন দুবার। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ মোট ছয়বার, পরিবেশমন্ত্রী ভূপেন্দ্র যাদব তিনবার এবং কৃষিমন্ত্রী শিবরাজ সিং একবার উঠে দাঁড়িয়ে রাহুলের বক্তব্য খণ্ডন করেন। বাদ যাননি সংসদীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজুও।
রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর বক্তৃতায় রাহুলের আক্রমণাত্মক ভাষণ সরকারপক্ষকে এতটাই ক্ষুব্ধ করেছে যে অমিত শাহ সরাসরি স্পিকারকে বলেন, বিরোধী নেতার ‘আপত্তিকর’ অংশগুলো যেন অবিলম্বে সভার কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়া হয়। আজ মঙ্গলবার সকালেই দেখা যায়, স্পিকার সেই দাবি মেনে রাহুলের ভাষণের অধিকাংশই বাদ দিয়েছেন।
গত লোকসভায়ও ঠিক এমনই হয়েছিল। রাহুলের ভাষণ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল আদানি ও আম্বানিসম্পর্কিত যাবতীয় প্রসঙ্গ। যে যে বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করেছিলেন, সেগুলোর অধিকাংশ বক্তব্য ‘অসংসদীয়’ বলে সভার কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। এবারও তারই পুনরাবৃত্তি ঘটল।
আজ সকালেই এর প্রতিবাদ জানান কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। স্পিকার ওম বিড়লাকে তিনি চিঠি লিখে বলেন যে তাঁর ভাষণের যেসব অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে, তা আদৌ নিয়মবিধি ভঙ্গ করেনি। রাহুল তাঁর চিঠিতে বাদ দেওয়া অংশ জুড়ে দিয়ে লিখেছেন, সংসদে মানুষের কথা বলা তাঁদের কর্তব্য। সেই কথা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিপন্থী।
রাহুলের ভাষণ বিজেপির শীর্ষ নেতাদের গাত্রদাহের কারণ হয়। কারণ, তিনি বিজেপির হিন্দুত্বকে আগাগোড়া আক্রমণ করেন। রাহুল বলেন, প্রকৃত হিন্দু কখনো হিংসার কথা বলে না, ঘৃণার কথা বলে না, অসত্য বলে না। মোদি, বিজেপি, আরএসএস হিন্দুধর্মের ঠিকাদার নয়। ওরা হিন্দুদের প্রতিনিধি নয়, হতে পারেও না। কারণ, তারা ২৪ ঘণ্টা হিংসা, ঘৃণা ছড়িয়ে চলেছে। অসত্য বলে চলেছে।
গোটা বিরোধী পক্ষকে দেখিয়ে রাহুল বলেন, ‘এখানে আমরা সবাই হিন্দু।’
হিন্দুত্বের অর্থ কী, তা বোঝাতে রাহুল দেবতা শিবের ছবি সভায় বারবার দেখান। প্রকৃত ধর্ম যে হিংসার কথা বলে না, তা বোঝাতে তিনি ইসলামের প্রার্থনা, গৌতম বুদ্ধ, যিশুখ্রিষ্ট, শিখ গুরু নানক দেবের ছবি দেখিয়ে প্রমাণ দেন।
রাহুলের ভাষণের মূল সুর ছিল বিজেপির ভয়ের রাজনীতি। তিনি বলেন, দেশের প্রত্যেক মানুষকে ভয় দেখিয়ে সংকুচিত করে রাখা হয়েছে। নারী, যুব সম্প্রদায়, কৃষক, ছাত্র, শ্রমিক, ছোট ব্যবসায়ী, সংখ্যালঘু সবাই কোনো না কোনো কারণে আতঙ্কিত। গৃহবধূ আতঙ্কিত মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে, যুব সম্প্রদায় চাকরি না পেয়ে, কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়ে, ছাত্ররা আতঙ্কিত পরীক্ষাব্যবস্থার ব্যবসায়ীকরণে, সংখ্যালঘু আতঙ্কিত জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা নিয়ে। এই আতঙ্কের বিরুদ্ধেই মানুষ রায় জানিয়েছে। বিজেপিকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে দেয়নি।
রাহুল বলেন, বিজেপির অভ্যন্তরেও এই ভয় জাঁকিয়ে বসেছে। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারেন না। রাজনাথ সিং, নিতিন গড়কড়িদের নাম নিয়ে তিনি বলেন, তাঁরা এমনিতে সৌজন্য বিনিময় করেন। কিন্তু মোদি থাকলে গুটিয়ে যান। রাহুল বলেন, ইন্ডিয়া জোট এই ভয়ের রাজনীতির বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়িয়েছে।
রাহুল এ প্রসঙ্গে টেনে আনেন সেনাবাহিনীর ‘অগ্নিবীর’ প্রকল্পকে। তিনি বলেন, এই প্রকল্প দেশের সেনাবাহিনীর মনোবল পুরোপুরি ভেঙে দিয়েছে। অগ্নিবীর শহীদ হলে অন্যান্য জওয়ানের মতো শহীদের মর্যাদা পান না। তাঁরা পেনশন পান না, সম্মান পান না। রাহুল বলেন, তাঁরা ক্ষমতায় এলে এই প্রকল্প তুলে দেবেন। জওয়ানদের মধ্যে শ্রেণি বিভাজন হতে দেবেন না।
আজ বিকেলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জবাবি ভাষণ দেন। তাঁর ভাষণের মূল লক্ষ্যই ছিলেন রাহুল গান্ধী ও কংগ্রেস। রাহুলকে তিনি এতকাল ‘শেহজাদা’ বলে সম্বোধন করে এসেছেন। আজকের ভাষণে তাঁকে সারাক্ষণ ‘বালকবুদ্ধি’ বলে উপহাস করেন। কংগ্রেস কীভাবে অপশাসন চালিয়ে এসেছে, কেন মানুষ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে, কীভাবে তারা দেশকে লুট করেছে, কত ভ্রষ্টাচার করেছে, প্রধানমন্ত্রী সেসবের ফিরিস্তি দিয়ে বলেন, এখন তারা দেশবাসীকে মিথ্যা বলে বিভ্রান্ত করছে। ভারতীয় সেনার মনোবল নষ্ট করছে।
মোদি বলেন, দেশবাসী জানতে চায়, কাদের স্বার্থে কংগ্রেস দেশের সেনাবাহিনীকে দুর্বল করতে চাইছে? কেন চাইছে দেশের যুব সম্প্রদায় সেনাবাহিনীতে যোগ না দিক?
বিজেপির তৃতীয় দফার সাফল্য, কংগ্রেসের মোট আসনসংখ্যা গত ১০ বছরে ১০০ ছুঁতে না পারার পাশাপাশি মোদি টেনে আনেন দেশের ১৪০ কোটি হিন্দুর অপমানের কথা। তিনি বলেন, ‘বালকবুদ্ধি’ যেভাবে হিন্দুদের হিংস্র হওয়ার কথা বলেছেন, তা এ দেশের হিন্দু সমাজ ১০০ বছরেও ভুলবে না। এর যোগ্য জবাব দেবে।
মোদির ভাষণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিরোধীরা স্লোগান দেন। সারাক্ষণ ‘গো টু মণিপুর’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘জয় সংবিধান’ বলে চেঁচাতে থাকেন। ‘শেম শেম’ ধ্বনি দেন। হিন্দুত্ব নিয়ে, ‘অগ্নিবীর’ প্রকল্প নিয়ে তিনি যখনই রাহুলের বক্তৃতার বিরোধিতা করেন, তখনই বিরোধীরা ‘ঝুট ঝুট’ বলে চিৎকার করেন।
একপর্যায়ে স্পিকারের উদ্দেশে মোদি বলেন, গতকাল যেভাবে সংসদের গরিমা নষ্ট করা হয়েছে, তা মানা যায় না। স্পিকারের উচিত এর বিধান করা।
এত কিছু বলা সত্ত্বেও মোদি তাঁর দীর্ঘ ভাষণে একবারের জন্যও ‘মণিপুর’ শব্দটি উচ্চারণ করেননি। যদিও বলতে ভোলেননি যে কংগ্রেসের সঙ্গে বিরোধীরা দেশের অগ্রগতি রোখার চক্রান্ত করে চলেছে। বিরোধীদের হুঁশিয়ার করে তিনি বলেন, যে ভাষায় তারা কথা বলছে, তার জবাব তারা ঠিক সেই ভাষাতেই পাবে।