স্বাধীনতার প্ল্যাটিনাম জুবিলি উদ্যাপনের প্রাক্কালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) প্রধান মোহন ভাগবত ‘অখণ্ড ভারত’ গঠনের যে লক্ষ্যমাত্রা আরও একবার নতুন করে বেঁধে দিলেন, তা বাস্তবায়নের অর্থ বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তার লোপ হওয়া। শুধু বাংলাদেশই নয়, এতে স্বাধীন সার্বভৌম সত্তা হারাবে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কাও। স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে গত রোববার নাগপুরে এক অনুষ্ঠানে ‘লক্ষ্য’ পূরণ নিয়ে কথা বলেন মোহন ভাগবত। তিনি বলেছেন, ‘অখণ্ড ভারত গঠনের স্বপ্নপূরণের পথে ভয়ই একমাত্র বাধা। যেদিন এই ভয় কাটানো যাবে, সেদিনই অখণ্ড ভারত গড়া সম্ভব হবে।’
মোহন ভাগবতের বক্তব্য অনুযায়ী, সেই অখণ্ড ভারত হবে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’। তার চরিত্র ও সংবিধান কেমন হবে, সেই খসড়াও প্রকাশিত হয়েছে। স্বাধীনতা দিবসের দুই দিন আগে গত শনিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনী কেন্দ্র বারানসিতে খসড়া সংবিধান প্রকাশ করে শঙ্করাচার্য পরিষদের পীঠাধ্যক্ষ ও সভাপতি স্বামী আনন্দ স্বরূপ বলেন, অখণ্ড ভারতে বসবাসকারী মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের ভোটাধিকার থাকবে না। ভোটাধিকার না থাকলেও এই দুই সম্প্রদায় অন্যদের মতো সব নাগরিক সুযোগ–সুবিধা ও অধিকার ভোগ করতে পারবেন। অখণ্ড ভারতের রাজধানী হবে বারানসি। নতুন ধর্ম সংসদও গড়ে তোলা হবে সেখানে।
অখণ্ড ভারতের সংবিধানের এই খসড়া তৈরি করছেন দেশের ৩০ জন ধর্মগুরু ও পণ্ডিত। গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রয়াগরাজের (আগের নাম এলাহাবাদ) ধর্ম সংসদে এই খসড়া প্রস্তুতের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। আগামী বছর প্রয়াগরাজে মাঘি (মাঘ মাসের) পূর্ণিমা মেলায় এই খসড়া সংবিধান চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হবে বলে আনন্দ স্বরূপ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অখণ্ড ভারতের প্রত্যেককে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হবে। কৃষিক্ষেত্র থাকবে আয়করমুক্ত।
খসড়া সংবিধানের প্রচ্ছদে অখণ্ড ভারতের যে মানচিত্র ছাপা হয়েছে, তাতে পশ্চিমে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান, পূর্বে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ এবং দক্ষিণে শ্রীলঙ্কার কোনো স্বকীয় অস্তিত্ব রাখা হয়নি। পাঁচটি দেশই ভারতের অন্তর্গত। একটি গৈরিক পতাকাও রাখা হয়েছে প্রচ্ছদে। সেটিই অখণ্ড ভারতের জাতীয় পতাকা হবে কি না, সে বিষয়টি অবশ্য স্পষ্ট করা হয়নি। আনন্দ স্বরূপ জানিয়েছেন, মূল সংবিধান হবে ৭৫০ পৃষ্ঠার। তার ৩৫০ পৃষ্ঠা আগামী বছর মাঘি পূর্ণিমার আসরে চূড়ান্ত পেশ করা হবে। তিনি বলেন, ভারতবর্ষ থেকে যেসব দেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, তাদের সবাইকে নিয়েই গঠিত হবে অখণ্ড ভারত—যা হবে হিন্দু রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রে ১৬ বছর বয়সীদের ভোটাধিকার থাকবে। ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বয়স হবে ২৫। বর্ণ প্রথা অনুযায়ী দেশ শাসিত হবে। ব্রিটিশ আমলের কোনো আইনের অস্তিত্ব থাকবে না। বিচারব্যবস্থা চলবে ত্রেতা ও দ্বাপর যুগে যেমন চলত সেই অনুযায়ী। শিক্ষাব্যবস্থায় আনা হবে জ্যোতিষচর্চা, গণিত, আয়ুর্বেদ। চর্চা হবে ভূগর্ভ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানেরও।
অখণ্ড হিন্দু রাষ্ট্রের এই খসড়া সংবিধান প্রকাশের পরের দিনেই মোহন ভাগবত নতুন করে ‘অখণ্ড ভারত’ গঠনের দিনক্ষণ ঠিক করে দেন। স্বাধীনতার শতবর্ষে ২০৪৭ সালে, সংঘ কোন লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়, তা নাগপুরের এক অনুষ্ঠানে তিনি স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘একমাত্র বাধা হলো ভয়। ভয় কাটলেই লক্ষ্য পূরণ সম্ভব। নিজেই নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন, যে দেশ এত বিশাল ছিল, তা কী করে এত কমে গেল? সংস্কৃত ব্যাকরণবিদের (পাণিনি) জন্মস্থান কেন ভারতের অন্তর্গত নয়? ভারতের প্রকৃত ইতিহাস জানতে হবে। সিন্ধু–সরস্বতী সভ্যতার বয়স ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের মতে সাড়ে তিন হাজার বছর। কিন্তু সেই সভ্যতার প্রকৃত বয়স ৯ হাজার বছর। সেই সভ্যতা ছিল সর্বগামী। তার ব্যাপ্তি ছিল সর্বত্র।’
অখণ্ড ভারত গঠনের এই সংকল্পের কথা মোহন ভাগবত বেশ কিছুদিন ধরেই বলে চলেছেন। বিজেপির চালিকা শক্তি আরএসএস প্রধান একই কথা বলেছিলেন গত ৭ আগস্ট, নাগপুরে বহু প্রচারিত মারাঠা দৈনিক লোকমতের এক অনুষ্ঠানে। চলতি বছরের ১৪ এপ্রিল হরিদ্বারে হিন্দুত্ববাদীদের এক সম্মেলনেও অখণ্ড ভারত গড়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘দেশের জন্য এক হয়ে আমরা সবাই যদি বাঁচতে ও মরতে শিখি, তা হলে অতি দ্রুত এই লক্ষ্য পূর্ণ হবে। এখন যে গতিতে চলছি, তাতে আর একটু গতি সঞ্চারিত হলে ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে স্বপ্ন সফল হবে। আরও একটু বাড়তি গতিতে চললে অর্ধেক সময় কমে যাবে।’
আরএসএসের ‘অখণ্ড ভারত’ ও সনাতন ধর্মগুরুদের ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ সেই রাষ্ট্রের প্রস্তাবিত নতুন সংবিধান, খসড়া, মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের ভোটাধিকার না থাকার বিষয়ে ক্ষমতাসীন বিজেপির শীর্ষনেতারা আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। কেন্দ্রীয় বা রাজ্য পর্যায়ের কোনো নেতাই মোহন ভাগবত বা আনন্দ স্বরূপের বক্তব্য নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। হায়দরাবাদের এআইএমআইএম নেতা ও সাংসদ আসাউদ্দিন ওয়েইসি অবশ্য টিপ্পনী কেটে বলেছেন, আগে চীন ও পাকিস্তানের কবজা থেকে জমি উদ্ধার করে দেখাক, তার পর না হয় অখণ্ড ভারতের কথা ভাবা যাবে।