পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গড়ার প্রস্তাব পাস, আবার অশান্ত হতে পারে দার্জিলিং

দার্জিলিং শহর। এই পাহাড়ি জনপদ কি আবার অশান্ত হয়ে উঠবে—পৃথক রাজ্য গঠনের প্রস্তাব পাসের পর সেই প্রশ্ন উঠছে
ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়ি অঞ্চল দার্জিলিংয়ের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা গোর্খাল্যান্ড টেরিটরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (জিটিএ) প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো গতকাল সোমবার। সে বৈঠকেই গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গড়ার প্রস্তাব পাস হয়েছে। পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গড়ার দাবিতে আবার উত্তাল হতে পারে পাহাড়।

গত ২৬ জুন জিটিএর ৪৫টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ২৭টি আসনে জয়ী হয় অনিত থাপার ভারতীয় গোর্খা প্রজাতান্ত্রিক দল। তৃণমূল পায় ৫টি আসন, হামারো পার্টি পায় ৮টি এবং নির্দলীয় প্রার্থীরা পান ৫টি আসন। জিটিএর চেয়ারম্যান হন অনিত থাপা।

গতকাল জিটিএর বৈঠকে এই প্রথম পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গড়ার দাবি মেনে নিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়। জিটিএর প্রধান অনিত থাপা বলেন, পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যর প্রস্তাবসহ এ বৈঠকে ৫৫টি প্রস্তাব পাস হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১১টি। দার্জিলিং ও কালিম্পংয়ের ১১টি জনজাতিকে উপজাতির স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাবও পাস হয়েছে।

শান্ত-নিরিবিলি দার্জিলিং

মাত্র ৫ দিন আগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে ছত্তিশগড়, হিমাচল প্রদেশ, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু ও উত্তর প্রদেশের ১৫টি সম্প্রদায়কে জনজাতির স্বীকৃতি দেওয়া হলেও দার্জিলিং ও কালিম্পংয়ের কোনো জনজাতিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তাই গতকাল জিটিএর বৈঠকে পাহাড়ের এই দুই জেলার ১১টি জনজাতিকে উপজাতির স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

এই স্বীকৃতির পর জিটিএর প্রধান অনিত থাপা বলেন, ‘আমরা এর আগে ১১ বার পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গড়ার প্রস্তাব তুলেও জিটিএতে পাস করাতে পারিনি। এবার পেরেছি। এবার আমরা পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য নিয়ে আন্দোলন শুরু করব।’

তবে জিটিএর তৃণমূল নেতা বিনয় তামাং বলেন, এভাবে প্রস্তাব পাস করলে সবকিছু হয়ে যায় না। তার জন্য কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হয়।পশ্চিমবঙ্গের কোনো রাজনৈতিক দলই চায় না দার্জিলিং বিচ্ছিন্ন হয়ে যাক পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্র থেকে। পর্যটন আর চা-শিল্পের ওপর নির্ভরশীল এই জেলা।

এখানের বেশির ভাগ মানুষ নেপালি ভাষাভাষী। ১৯৮০ সাল থেকে সেই একই ঘটনা ঘটছে দার্জিলিংয়ের রাজনীতিতে। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতা বিমল গুরুং সেদিন যেভাবে গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের (জিএনএলএফ) কাউন্সিলর হয়ে দলীয় প্রধান সুভাষ ঘিসিংয়ের সঙ্গে বিরোধিতা করে দল ছেড়ে গড়েছিলেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা, এখন সেই তিনিই কার্যত সরে গেছেন ইতিহাসের পাতা থেকে।

১৯৮০ সালে পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবি নিয়ে দার্জিলিংয়ে প্রথম আন্দোলন শুরু করেন জিএনএলএফের নেতা সুভাষ ঘিসিং। পরে ১৯৮৮ সালের ২২ আগস্ট বামফ্রন্ট সরকার জিএনএলএফ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যস্থতায় গড়ে পৃথক স্বশাসিত সংস্থা দার্জিলিং গোর্খা পার্বত্য পরিষদ। এর চেয়ারম্যান করা হয় সুভাষ ঘিসিংকে। অন্যদের মধ্যে কাউন্সিলর হন বিমল গুরুংও।

একসময় সুভাষ ঘিসিংয়ের সঙ্গে বিমল গুরুংয়ের মতবিরোধ দেখা দিলে বিদ্রোহ করেন বিমল গুরুং। তারপরই ২০০৭ সালের ৭ অক্টোবর বিমল গুরুং গড়েন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। এরপর জনমুক্তি মোর্চা পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন করে অশান্ত করে তোলে দার্জিলিং। দার্জিলিং থেকে প্রকারান্তরে তাড়িয়ে দেওয়া হয় সুভাষ ঘিসিংকে। তিনি আশ্রয় নেন জলপাইগুড়িতে। এরপর আর তিনি ঠাঁই পাননি দার্জিলিংয়ে। মারাও যান দার্জিলিংয়ের বাইরে জলপাইগুড়িতেই।

সুভাষ ঘিসিংয়ের বিদায়ের পর বিমল গুরুংয়ের আন্দোলন থামাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা এগিয়ে আসেন। কথা দেন, দার্জিলিংয়ে ফিরিয়ে আনবেন শান্তি। এরপরই মমতার উদ্যোগেই ২০১১ সালের ১৮ জুলাই সেই ১৯৮৮ সালের ধাঁচে গড়া হয় জিটিএ। এই জিটিএর চেয়ারম্যান হন বিমল গুরুং আর কাউন্সিলর হন বিনয় তামাং।

এবার ইতিহাসের পথ ধরে সেই ধারাবাহিকতায় জনমুক্তি মোর্চার নেতা বিনয় তামাং বিদ্রোহ করে বসেন বিমল গুরুংয়েরই বিরুদ্ধে। ছাড়েন বিমল গুরুংয়ের সংস্রব। বিমল গুরুংয়ের অফিস দখল করে নামিয়ে দেন তাঁর ছবি। ওড়ান দলের নতুন পতাকা। আর এ কাজে বিনয় তামাংয়ের পাশে এসে দাঁড়ান মমতা। তাঁকে জিটিএর চেয়ারম্যান করেন। মুছে যেতে শুরু করে বিমল গুরুংয়ের নাম।

পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবিতে ১০৭ দিন একটানা বন্‌ধের পর তা প্রত্যাহার করে নেন বিমল গুরুং। তবু পুরোপুরি শান্তি ফিরে আসেনি পাহাড়ে। এরই মধ্যে গতকাল জিটিএর প্রথম বৈঠকেই পাস হলো পৃথক রাজ্য গোর্খাল্যান্ড করার প্রস্তাব। এবার রাজ্যবাসী তাকিয়ে আছে কী ঘটতে চলেছে দার্জিলিংয়ে, সেদিকে।