ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

মুসলমানদের আক্রমণ: মোদির শাস্তির দাবিতে ইসিতে হাজারো নাগরিকের চিঠি, কোনো ব্যবস্থা নেই

ভারতের হাজার হাজার নাগরিক নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চিঠি লিখে জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কংগ্রেস ও মুসলমানদের নিয়ে নির্বাচনী জনসভায় যা বলেছেন, তা ভয়ংকর। ভারতীয় মুসলমানদের প্রধানমন্ত্রী সরাসরি আক্রমণ করেছেন। কমিশন ব্যবস্থা না নিলে তা সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা ও স্বশাসনের চরিত্রকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবে।

বিশিষ্ট নাগরিকদের চিঠি সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন কিন্তু নির্বিকার। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, আদর্শ নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ, রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের দাবি নিয়ে একটি মন্তব্যও তারা করেনি। অথচ এই কমিশনই মাত্র কয়েক দিন আগে এক বিজেপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে ‘আপত্তিকর মন্তব্য’ করার জন্য কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সিং সুরযেওয়ালাকে ৪৮ ঘণ্টা প্রচার না করার শাস্তি দিয়েছিল। তাঁর অপরাধ, উত্তর প্রদেশের মথুরা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী হেমা মালিনীর বিরুদ্ধে তিনি কিছু ‘কুমন্তব্য’ করেছিলেন।

গত রোববার রাজস্থান রাজ্যের বাঁশবাড়া ও পরদিন গতকাল সোমবার উত্তর প্রদেশের আলিগড়ে নির্বাচনী জনসভায় প্রধানমন্ত্রী মোদি কংগ্রেসকে আক্রমণ করে বলেন, ক্ষমতায় এলে তারা সাধারণ মানুষের ধন–সম্পত্তি দখল করে মুসলমানদের মধ্যে বিলি–বাঁটোয়ারা করে দেবে। এ কথা তারা তাদের দলের নির্বাচনী ইশতেহারেও জানিয়ে দিয়েছে।

পর পর দুটি জনসভায় মোদি আরও বলেছেন, তারা যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও তাঁর সরকারের এ ধরনের অভিপ্রায়ের কথা বলেছিলেন। দুই জনসভাতেই মোদি জানতে চেয়েছেন, এই কংগ্রেসকে জনগণ ভোট দেবেন কি না। জানতে চেয়েছেন, তাঁরা কি চান, তাঁদের কষ্টার্জিত সম্পত্তি যারা শুধু কাঁড়ি কাঁড়ি বাচ্চার জন্ম দেয়, তাদের মধ্যে বাঁটোয়ারা হোক? তাঁদের সম্পদের মালিক হোক অনুপ্রবেশকারীরা?

ইসির কাছে গতকাল সোমবার দুটি আবেদন পৌঁছেছে। একটি ‘সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল’ নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে। তাতে সই করেছেন ২ হাজার ২০৯ বিশিষ্ট নাগরিক। ইসিকে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলে তাঁরা জানিয়েছেন, যে ভাষায় মোদি কথা বলেছেন, তাতে বিশ্বের কাছে ‘গণতন্ত্রের ধাত্রী’র মর্যাদা হানি হয়েছে ভয়ংকরভাবে।

দ্বিতীয় আবেদন পাঠিয়েছে ‘সংবিধান বাঁচাও নাগরিক অভিযান’ নামের আরেকটি সংগঠন। তাতে সই করেছেন ১৭ হাজার ৪০০ মানুষ। সেই আবেদনে বলা হয়েছে, এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আদর্শ নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের পাশাপাশি ১৯৫১ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনও ভঙ্গ করেছেন। কারণ, ওই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শুধু সাম্প্রদায়িকতাতেই উসকে দেননি, মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ঘৃণাও বাড়িয়ে দিয়েছেন।

এই সংগঠনের স্বাক্ষরদাতারা আরও বলেছেন, কংগ্রেস দল, তাদের ইশতেহার ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে মোদি শুধু নির্জলা মিথ্যাই বলেননি, মুসলমানদের তিনি অনুপ্রবেশকারী বলেছেন। অসম্মান করেছেন গাদা গাদা সন্তান উৎপাদন করে বলে। আবেদনে তাঁরা বলেছেন, এখনই মোদিকে ভর্ৎসনা করা হোক। তাঁর প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হোক, যা এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে কমিশন করেছে।

কিন্তু কমিশন অদ্ভুতভাবে নির্বিকার ও নিরুত্তর। এত গুরুতর মন্তব্যের পর ৪৮ ঘণ্টা কেটে গেলেও ব্যবস্থা গ্রহণ তো দূরের কথা, কোনো মন্তব্য পর্যন্ত তারা করেনি। দ্বিতীয় দফার নির্বাচন আগামী শুক্রবার।

২০২২ সালে সুপ্রিম কোর্টে এক মামলায় হলফনামা দিয়ে ইসি বলেছিল, ঘৃণা ভাষণ বন্ধে নির্দিষ্ট কোনো আইন নেই বলে কোনো রাজনৈতিক দল বা তার নেতাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করার ক্ষমতা তাদের নেই। তবে জনপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী তারা এ ধরনের ঘটনায় কিছু কিছু ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।

ওই মামলাটি করেছিলেন আইনজীবী অশ্বিনী উপাধ্যায়। আবেদনে তিনি বলেছিলেন, ঘৃণা ভাষণ নিয়ে আইন কমিশনের প্রতিবেদনের সুপারিশ কেন্দ্রীয় সরকার রূপায়ণ করুক।

ভোট আবহে কী কী করা যাবে না, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের নীতিমালা অবশ্য আছে। তাতে স্পষ্ট বলা আছে, জাত, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা বা সম্প্রদায়ের নামে ভোট চাওয়া যাবে না। এমন কিছু বলা যাবে না, যাতে সমাজে উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে। সাম্প্রদায়িক বা জাতিগত সংঘাতের পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। এ কথাও বলা হয়েছে, প্রচারের সময় প্রার্থীদের ব্যক্তিগত জীবনের সমালোচনা করা অনুচিত।

এ ধরনের বিচ্যুতিতে নির্বাচন কমিশন অনেক ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে। তারা প্রথমে অভিযুক্তকে নোটিশ পাঠাতে পারে। ব্যাখ্যা দাবি করতে পারে। তাতে সন্তুষ্ট না হলে কিছু সময়ের জন্য প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে। ভর্ৎসনা করতে পারে।

ঘটনা হলো ২০১৪ সালের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য অমিত শাহসহ একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে আচরণবিধি ভঙ্গ ও ঘৃণা ভাষণ দেওয়ার অভিযোগ আনা হলেও আজ পর্যন্ত কমিশন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ভর্ৎসনা পর্যন্ত করেনি।

২০১৯ সালে পুলওয়ামা–কাণ্ডকে নির্বাচনী প্রচারে হাতিয়ার করা নিয়ে মোদির বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ জমা পড়েছিল। সাম্প্রদায়িকতায় উসকানি দিয়ে ভোট ভিক্ষার একাধিক অভিযোগও আনা হয়েছিল মোদি–শাহর বিরুদ্ধে।

সেসব অভিযোগ খতিয়ে দেখার সময় তৎকালীন অন্যতম নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভাসা সেসব গুরুতর মনে করেছিলেন। কিন্তু তাঁর আপত্তি অগ্রাহ্য করেছিলেন কমিশনের বাকি দুই সদস্য। কমিশনের সিদ্ধান্তে অশোক লাভাসা অসন্তোষ প্রকাশ করে ‘নোট’ দিয়েছিলেন। কিন্তু তা প্রকাশ করা হয়নি।

লাভাসাকে কমিশন ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। তাঁর স্ত্রী, ছেলে ও বোনের বিরুদ্ধে আয়কর বিভাগ তদন্ত চালিয়েছিল। নানা অভিযোগ আনা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে অবশ্য জানা যায়নি সেসব তদন্তের হাল কী হয়েছিল।

আচরণবিধি অনুযায়ী, নির্বাচনী প্রচারে ধর্মের ব্যবহার অনৈতিক ও অন্যায় হলেও এবার রাম নবমীতে আসামে প্রচারে গিয়ে মোদি সরাসরি ধর্মের আধারে ভোট চেয়েছেন। সেদিন অযোধ্যা মন্দিরে ‘সূর্য তিলক’ অনুষ্ঠান ছিল। তার উল্লেখ করে ও ‘জয় শ্রীরাম ধ্বনি’ দিয়ে নির্বাচনী জনসভায় মোদি সবাইকে ওই সময় মুঠোফোনের আলো জ্বালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।

জনসভার পর রামলালার কপালে পরা সূর্য তিলকের ছবি দিয়ে বিজেপির সরকারি ‘এক্স’ হ্যান্ডেলে লেখা হয়েছিল, ‘আপনার একটি ভোটের ক্ষমতা এমনই।’

মিরাটের জনসভায় অমিত শাহ মাথার ওপর রামলালার ছবি তুলে ধরলেও কমিশন নীরব থেকেছে। বিজেপি এমন প্রচারও করে চলেছে, ‘যারা রামকে এনেছে, আমরা তাদের জেতাব।’

প্রার্থীর ছবি দিয়ে ‘রামমন্দিরের জন্য একটা ভোট’ প্রার্থনার প্রচারও সামাজিক মাধ্যমে বিজেপি চালাচ্ছে। অথচ কোনো ক্ষেত্রে কমিশন দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি কাউকে দেয়নি।