দেশের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ রক্ষায় ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধনে না গিয়ে কংগ্রেস ও ‘ইন্ডিয়া’ জোট আগামী লড়াইয়ের অভিমুখ স্থির করে ফেলল। শিবসেনার উদ্ধব ঠাকরে, সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব, তৃণমূল কংগ্রেসের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি আগেই জানিয়েছিলেন, ওই অনুষ্ঠানে তাঁরা যাবেন না। গতকাল বুধবার কংগ্রেসও সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত হওয়ায় আসন্ন লোকসভা ভোটের লড়াইয়ে ধর্মই বড় হয়ে উঠতে চলেছে। বিজেপি নেতৃত্ব ইতিমধ্যেই আগামী নির্বাচনকে ‘সনাতন ধর্ম রক্ষার’ লড়াই হিসেবে চিহ্নিত করে দিয়েছে।
রামমন্দিরের প্রতিষ্ঠা দিবসে উপস্থিত থাকার জন্য ওই মন্দিরের তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্টের পক্ষে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কংগ্রেস সভাপতি ও রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে, কংগ্রেস সংসদীয় দলের নেত্রী সোনিয়া গান্ধী ও লোকসভার বিরোধী নেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আড়াই সপ্তাহের টানাপোড়েন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণের পর গত বুধবার কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব দলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। দলের মুখপাত্র জয়রাম রমেশ এক বিবৃতিতে বলেন, অযোধ্যার কর্মসূচি পুরোপুরি বিজেপি ও আরএসএসের নিজস্ব। দেশের লাখ লাখ মানুষ রামের পূজা করেন। ধর্ম একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু বিজেপি ও আরএসএস রামমন্দিরের ওপর থাকা মানুষের আস্থার রাজনৈতিকীকরণ করছে। সেটা করছে স্রেফ ভোটের কথা ভেবে। তাই তড়িঘড়ি অসম্পূর্ণ মন্দিরের উদ্বোধন করতে যাচ্ছে।
জয়রাম রমেশ বিবৃতিতে এ কথাও জানাতে ভোলেননি যে এই মন্দির নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রতি কংগ্রেস শ্রদ্ধাশীল। রামচন্দ্রের উপাসকদের আবেগের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল। তবু অনুষ্ঠানে যোগদানের আমন্ত্রণ শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করছে। কেন সেই প্রত্যাখ্যান, তার কারণ যে বিজেপি–আরএসএসের রাজনৈতিক স্বার্থ, ওই বিবৃতিতে তা স্পষ্ট বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
নিশ্চিতভাবেই এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে কংগ্রেস এবং ‘ইন্ডিয়া’ জোট এক বড় রাজনৈতিক ঝুঁকি নিল।
বিজেপি জানত, কংগ্রেস যাবে না। না গেলে তাদের যে ‘হিন্দুবিরোধী’ বলা হবে, তা কংগ্রেসও জানত।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি কালক্ষেপণ না করে কংগ্রেসকে ‘সনাতন ধর্মবিরোধী’ বলে দাগিয়েও দিয়েছেন।
বিজেপি নেতারাও বিরোধীদের ‘রামমন্দিরবিরোধী’ বলে প্রচার শুরু করেছেন। এই প্রচারের মধ্য দিয়ে উত্তর ভারতে বিজেপি যে তাদের হিন্দু ভোটব্যাংক জোরদার করবে সে কথাও কংগ্রেসের জানা ছিল। তবু তারা এই ঝুঁকি নিয়েছে দেশের ‘ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র’ রক্ষার স্বার্থে।
কংগ্রেস নেতারা নিভৃত আলোচনায় বলছেন, ১৯৮৫ সালে শাহ বানু মামলায় খোরপোশ দেওয়াসংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের যুগান্তকারী রায় খারিজ করতে তৎকালীন রাজীব গান্ধী সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তাতে হিতে বিপরীত হয়েছিল। বিজেপির কট্টর হিন্দুত্বের মোকাবিলায় নরম হিন্দুত্ব অনুসরণের নীতি ফলদায়ী হয়নি। কংগ্রেস তাই এবার দেশের প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র রক্ষায় নীতিগত ভূমিকা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কংগ্রেসের এক শীর্ষস্থানীয় নেতার কথায়, ‘অনেক ভেবেচিন্তে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
নীতিগত আদর্শ রক্ষায় কংগ্রেস দ্বিচারিতা করতে চায় না।’ ওই নেতা বলেন, ‘বিজেপি যে এই সিদ্ধান্তকে হাতিয়ার করবে, তা তাঁরা ভালোই জানেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও কংগ্রেস চায় সমভাবাপন্ন সঙ্গীদের নিয়ে তার বিরোধিতা করতে, দেশের সংবিধান রক্ষায় ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে দাঁড়াতে।’
বিজেপির ‘হিন্দুবিরোধী’ প্রচার নস্যাৎ করতে কংগ্রেস হিন্দু ধর্মপ্রচারকদেরই অস্ত্র করেছে। শঙ্করাচার্যরাও যে বিজেপি–আরএসএসের এই উদ্যোগ ‘রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থে’ বলেছেন, কংগ্রেস মুখপাত্র পবন খেরা তা জানাতে ভোলেননি। তিনি বলেন, উত্তরাখন্ডের শঙ্করাচার্য অভিমুক্তেশ্বরানন্দ সরস্বতী বলেছেন, রাজনৈতিক স্বার্থে বিজেপি অসম্পূর্ণ মন্দির উদ্বোধন করতে চলেছে। পুরীর শঙ্করাচার্য নিশ্চলানন্দ সরস্বতী বলেছেন, মন্দির উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে তিনি যাবেন না। কারণ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেখানে মধ্যমণি, যেখানে তিনি লোকার্পণ করবেন, সেখানে হাততালি দিতে তিনি উপস্থিত থাকবেন না। কংগ্রেস নেতারা বলছেন, মোদিই মধ্যমণি। তাঁকে তুলে ধরাই বিজেপির উদ্দেশ্য। প্রচারের সব আলো তাঁর মুখে ফেলা হচ্ছে ১০ বছরের চূড়ান্ত ব্যর্থতা থেকে দেশবাসীর নজর ফেরাতে।
মোদি–মাহাত্ম্য প্রচারের জন্যই রামমন্দির উদ্বোধনের অনুষ্ঠান থেকে বিজেপি সন্তর্পণে আড়াল করতে চেয়েছিল এই আন্দোলনের মূল হোতা লালকৃষ্ণ আদভানিদের। যে আদভানি অযোধ্যা আন্দোলনের জনক, রাম জন্মভূমি উদ্ধারে যিনি রথযাত্রা শুরু করেছিলেন, সঙ্গী ছিলেন মুরলী মনোহন যোশীরা, বয়সের কারণে বিজেপি তাঁদের এই অনুষ্ঠানে যেতে নিষেধ করেছে। কিন্তু সরকারের সেই আকাঙ্ক্ষা বা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রামমন্দির আন্দোলনের মূল আয়োজক বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আদভানিকে ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। পরিষদের ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট অলোক কুমার, আরএসএস নেতা কৃষ্ণ গোপাল ও রাম লাল বুধবার আদভানির বাড়ি গিয়ে তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। তাঁরা বলেছেন, নবতিপর নেতার যাতে কোনো রকম অসুবিধা না হয়, তা তাঁরা নিশ্চিত করবেন। তাঁর চিকিৎসার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, সব ব্যবস্থা সেখানে থাকবে। মন্দির উদ্বোধন হবে অথচ আদভানি অযোধ্যায় উপস্থিত থাকবেন না, তা হয় না।