সংসদে রাহুল

মোদির কল্যাণে আদানি সাম্রাজ্যের বিস্তার

রাহুল গান্ধী
রাহুল গান্ধী

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে শিল্পপতি গৌতম আদানির সম্পর্কের রসায়ন ও আদানির সাম্রাজ্য বিস্তারে তাঁর অবদান তুলে ধরে সরকারকে কঠোর সমালোচনা করলেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। আজ মঙ্গলবার লোকসভায় রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ জ্ঞাপক প্রস্তাবে অংশ নিয়ে রাহুল বললেন, এই সম্পর্কের রসায়ন এমনই যে বিদ্যুৎ, বন্দর, প্রতিরক্ষা, অবকাঠামোসহ এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে আদানি সাম্রাজ্যের বিস্তার হয়নি।

রাহুল বলেন, প্রধানমন্ত্রী একের পর এক বিদেশে গেছেন আর আদানির সাম্রাজ্যের পরিধি ও ব্যাপ্তি বেড়েছে। তা সে ইসরায়েল হোক, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা বা বাংলাদেশ হোক। নরেন্দ্র মোদি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী, আদানি তখন থেকেই তাঁর অনুগত ছায়াসঙ্গী। মোদিকে তিনিই উদ্বুদ্ধ করেন দেশ–বিদেশের শিল্পপতিদের ডেকে ‘ভাইব্রেন্ট গুজরাট’ বা ‘রিসার্জেন্ট গুজরাট’ সম্মেলন আয়োজন করার। মোদি তা করলেন। তারপর ২০১৪ সাল থেকে দেখা গেল আসল ম্যাজিক।

রাহুল বলেন, প্রধানমন্ত্রী প্রথম বিদেশ সফরে বাংলাদেশ গেলেন। বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড আদানির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করে ফেলল।

কংগ্রেস নেতা বলেন, এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে আদানির পা পড়েনি। ভারত জোড়ো যাত্রায় সারাক্ষণ শুধু এই একটা নামই শুনতে হয়েছে। আদানি, আদানি, আদানি। শুনতে হয়েছে, কী এমন রহস্য যে আদানি যাতে হাত দেন, তাতেই সফল হন? কী করে ২০১৪ থেকে মাত্র ৮ বছরের মধ্যে আদানির সাম্রাজ্যের বহর ৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ১২০ বিলিয়নে পৌঁছে যায়? এই রহস্যের উত্তর একটাই। নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের রসায়ন।

মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদনের পর থেকে সংসদের উভয় কক্ষে প্রতিদিন অধিবেশন ভণ্ডুল হয়ে যাচ্ছিল। বিরোধীদের দাবি ছিল, আদানির বিরুদ্ধে ওঠা কারচুপির অভিযোগের জবাব সরকারকেই দিতে হবে। তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। অবশেষে মঙ্গলবার বিরোধীরা রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ জ্ঞাপন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা রাজি হয়। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে রাহুল আদানি প্রসঙ্গে কথা বলেন। বিজেপি সদস্য ও সরকারের মন্ত্রীরা নানাভাবে তাঁকে বাধা দিতে থাকেন। মোদি-আদানি সম্পর্ক নিয়ে তাঁর সব অভিযোগ অবান্তর ও মনগড়া দাবি করতে থাকেন। রাহুল তাতে দমেননি। কীভাবে মোদির সাহায্যে আদানির বাণিজ্য বিস্তার লাভ করেছে, একের পর এক সেই উদাহরণ তুলে ধরেন। যেমন, বিমানবন্দর আধুনিকীকরণ ও হস্তান্তর।

পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় কংগ্রেসের বিক্ষোভের সময় গতকাল সোমবার মোদি ও আদানির কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়

রাহুলের অভিযোগ, আগে নিয়ম ছিল, অভিজ্ঞতা না থাকলে কেউ ওই কাজের দায়িত্ব পাবেন না। আদানির জন্য সরকার সেই নিয়ম বদলায়। ফলে দেশের ছয়টি বড় বিমানবন্দর চলে যায় আদানির কাছে। সেখান থেকে মোট আয়ের ৩০ শতাংশ আসে আদানির ঘরে। দেশে সবচেয়ে বেশি লাভ করে মুম্বাই বিমানবন্দর। সেটা ছিল ‘জিভিকে’ সংস্থার কাছে। ইডি, সিবিআইয়ের মতো সংস্থাকে দিয়ে ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে মুম্বাই বিমানবন্দর কেড়ে নিয়ে তুলে দেওয়া হয় আদানির হাতে।

সরকার পক্ষের প্রবল বিরোধিতার মুখে রাহুল বলতে থাকেন, সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার করে কীভাবে সম্পদ বৃদ্ধি করা যায়, আদানি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। প্রধানমন্ত্রী ইসরায়েল সফরে গেলেন। আদানি পেয়ে গেলেন ছোট অস্ত্র তৈরির বিপুল বরাত। ভারত-ইসরায়েল প্রতিরক্ষা চুক্তির মূল লাভ ছেঁকে ঘরে তুললেন আদানি। মোদি অস্ট্রেলিয়া সফরে গেলেন। স্টেট ব্যাংক আদানিকে কয়লা খনি কিনতে বিপুল ঋণ দিয়ে দিল। বাংলাদেশে গেলেন প্রধানমন্ত্রী। আদানি পেয়ে গেলেন বিদ্যুৎ সরবরাহের বরাত। ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য চুক্তি হলো দীর্ঘ মেয়াদের। তিনি শ্রীলঙ্কা গেলেন। সে দেশের বিদ্যুৎ বিভাগের চেয়ারম্যান অভিযোগ করলেন, প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে তাঁকে বিদ্যুৎ প্রকল্পের বরাত আদানিকে দেওয়ার অনুরোধ করেছেন।

রাহুলের অভিযোগ, ভারতের পররাষ্ট্রনীতি ভারতের স্বার্থে নয়, পুরোটাই আদানির স্বার্থে। গত সোমবার কর্ণাটকে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড (হ্যাল) নিয়ে তাঁর সমালোচনা করেছেন। ঘটনা হলো, রাফালের ১২৬টি বিমান তৈরির কথা ছিল হ্যালের। তাদের কাছে থেকে তা কেড়ে দেওয়া হয় অনিল আম্বানির সংস্থাকে। অথচ সেই সংস্থা এখন দেউলিয়া।

রাহুলের বক্তব্য এবং এই বিতর্কের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সভাকক্ষে ছিলেন না। রাহুল বলেন, প্রধানমন্ত্রীর জন্য তিনি সরাসরি কয়েকটা প্রশ্ন রাখছেন। যেমন, আদানির সংস্থাগুলোতে যে সব শেল কোম্পানি টাকা ঢালছে, তারা কারা? কাদের অর্থ ঘুরপথে দেশে ঢুকছে? কত টাকা আসছে? দেশের নিরাপত্তার জন্যই এসব জানানো প্রয়োজন।
রাহুল বলেন, একটা সময় ছিল যখন আদানির বিমানে মোদি ঘুরতেন। এখন মোদির বিমানে আদানি ঘোরেন। গৌতম আদানির সঙ্গে মোদির পুরোনো ছবিও তিনি সভায় তুলে ধরেন।
     
প্রধানমন্ত্রীর কাছে রাহুল কয়েকটি প্রশ্নও রেখেছেন। তাঁর আশা, প্রশ্নগুলোর জবাব প্রধানমন্ত্রী দেবেন। যেমন গৌতম আদানিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি কতবার বিদেশ সফরে গেছেন, কতবার আদানি একই দেশে আলাদাভাবে গেছেন, কতবার কোন কোন দেশে প্রধানমন্ত্রীর সফর শেষ হওয়ার পরপরই আদানি গেছেন, সরকারের কাছ থেকে মোট কত টাকার প্রকল্প আদানি পেয়েছেন, ২০ বছরে বিজেপিকে আদানি কত টাকা চাঁদা দিয়েছেন, নির্বাচনী বন্ড মারফতই বা বিজেপিকে কত টাকা দিয়েছেন।