তৃণমূল কংগ্রেসের লোকসভা সদস্য মহুয়া মৈত্রর সংসদ সদস্যপদ খারিজের সুপারিশ করল ‘এথিকস কমিটি’। তাঁর বিরুদ্ধে অর্থের বিনিময়ে সংসদে প্রশ্ন করার যে অভিযোগ শাসক দল বিজেপি করেছিল, অতি দ্রুত তার ‘তদন্ত’ শেষ করে এথিকস কমিটি ওই সুপারিশ চূড়ান্ত করেছে। প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার রিপোর্টে মহুয়ার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগের তদন্ত করতেও সরকারকে সুপারিশ করা হয়েছে। এথিকস কমিটির ওই সুপারিশ আজ শুক্রবারই পেশ করা হবে লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লার কাছে।
মহুয়ার সংসদ সদস্যপদ খারিজের পক্ষে ভোট দেন ছয় সদস্য। বিরুদ্ধে ভোট দেন পাঁচজন (এক সদস্য ই-মেইলের মাধ্যমে)। সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরু হবে আগামী ৪ ডিসেম্বর। ওই অধিবেশনেই এই সুপারিশ গ্রহণ বা বর্জনসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন স্পিকার।
এথিকস কমিটিতে এত দ্রুত কোনো অভিযোগের মীমাংসা আজ পর্যন্ত হয়নি। সেই কারণে মহুয়া একে ‘ক্যাঙারু কোর্ট’ বলে অভিহিত করে বলেন, ‘আমি আবার আরও বেশি ভোটে জিতে লোকসভায় ফিরে আসব।’ তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ও লোকসভার সদস্য অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় মহুয়ার সমর্থনে গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকার ও আদানি নিয়ে প্রশ্ন তোলায় মহুয়াকে প্রতিহিংসার শিকার হতে হলো।’
বিরোধীরা এ কথাও বলেছেন, অনেকের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ এথিকস কমিটিতে পড়ে রয়েছে। বিজেপির সদস্য রমেশ বিধুরি সভায় অন্য সদস্যের বিরুদ্ধে কুকথা বলেছেন। চরম আপত্তিজনক মন্তব্য করেছেন। অথচ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বোঝাই যাচ্ছে, সরকার ও আদানি নিয়ে প্রশ্ন তুললে বহিষ্কৃত হওয়ার ঝুঁকি সহ্য করতে হবে।
কয়েক মাস যাবৎ আদানি গোষ্ঠীর ব্যবসা–বাণিজ্য নিয়ে মহুয়া বেশ কিছু প্রশ্ন করছিলেন। ঝাড়খন্ড জেলার গোড্ডা (ওখানে আদানির প্রকল্প থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি হয়) কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত বিজেপির নিশিকান্ত দুবে স্পিকারকে চিঠি লিখে মহুয়ার বিরুদ্ধে ‘অনৈতিকতার’ অভিযোগ আনেন। তাঁর অভিযোগ, শিল্পপতি দর্শন হিরানন্দানির কাছ থেকে নানাবিধ ‘সুবিধা’ নিয়ে তাঁর ব্যবসায়িক স্বার্থে মহুয়া প্রশ্নই শুধু করেননি, ই-মেইলের লগইন পাসওয়ার্ড পর্যন্ত ওই ব্যবসায়ীকে দিয়েছিলেন, যাতে তিনি সরাসরি প্রশ্ন পাঠাতে পারেন। দুবের অভিযোগ, দুবাইয়ে বসে হিরানন্দানি সেই কাজ করেছেন, যা ‘দেশের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক’।
এথিকস কমিটির বিরোধী সদস্যরা (ইন্ডিয়া জোট) প্রত্যেকেই মহুয়ার পক্ষে দাঁড়িয়ে ওই সুপারিশের বিরুদ্ধে ভোট দেন। চারজন বৈঠকে থেকে বিরুদ্ধাচরণ করেছেন, কংগ্রেসের উত্তম রেড্ডি তেলেঙ্গানার ভোটে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দরুন উপস্থিত ছিলেন না। তাই তিনি তাঁর মতামত ই–মেইলে জানিয়ে দেন। সেটা গ্রহণ করা হবে কি না, তা ঠিক করবেন স্পিকার। গৃহীত না হলে ভোটের ফল হবে ছয়-চার।
বিরোধীদের অভিযোগ, গতকালের বৈঠকে কমিটির চেয়ারম্যান বিজেপির সদস্য বিনোদ সোনকর কুড়ি মিনিট পর সভায় আসেন এবং আড়াই মিনিটের মধ্যে রিপোর্ট চূড়ান্ত হয়ে যায়। ১৮ বছর আগে তৎকালীন বিরোধী দল বিজেপির সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে প্রশ্ন করার অভিযোগের তদন্ত হয়েছিল আট মাস ধরে। খতিয়ে দেখা হয়েছিল ৫৬টি ভিডিও, ৭০টি অডিও রেকর্ডিং এবং ৯০০টি ফোন কল। মহুয়ার ক্ষেত্রে দেখা হয়েছে মাত্র একটি ভিডিও ফুটেজ। মহুয়া দাবি করেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে হলফনামা দেওয়া ব্যবসায়ী হিরানন্দানিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার অধিকার তাঁকে দেওয়া হোক। এথিকস কমিটি সেই দাবি মানেনি।
দেরিতে হলেও তৃণমূল কংগ্রেস মহুয়ার পাশে দাঁড়িয়েছে। ইন্ডিয়া জোটের অন্যান্য শরিকও মহুয়ার পাশে। মহুয়া নিজে বলেছেন, আদানির বিরুদ্ধে মুখ খোলার জন্যই তাঁর এই হেনস্তা। নিজের নির্বাচনী কেন্দ্র নদিয়া জেলার তেহট্টতে গতকাল তিনি বলেন, ‘কোন ঘুঘুর বাসায় হাত দিয়েছি, সেটা দেখতে হবে। ওরা আমাকে মেরে ফেলেনি, এটাই অনেক।’ সিবিআই–ইডিকে দিয়ে তদন্তের সুপারিশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আসুক না। গুনে যাক আমার কটা শাড়ি আছে, কটা জুতা। কিচ্ছুটি ওরা করতে পারবে না। লোকসভার মেয়াদ রয়েছে মাস তিনেক। তারপর আরও বেশি ভোটে জিতে ফিরে আসব।’
আদানি গোষ্ঠীর কর্ণধার গৌতম আদানির ব্যবসা–বাণিজ্য, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁর ‘সম্পর্ক’, আদানির জন্য বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা সরকারের কাছে প্রধানমন্ত্রীর দরবার করা সংক্রান্ত বহু প্রশ্ন সংসদে তোলা হলেও সরকার আজ পর্যন্ত একটিরও জবাব দেয়নি। প্রধানমন্ত্রী মোদিও তাঁর নীরবতা ভাঙেননি। কংগ্রেসের অভিযোগ, আদানিকে নিয়ে প্রশ্ন করার জন্যই রাহুল গান্ধীর সদস্যপদ খারিজ করা হয়েছিল। অধীর চৌধুরীকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল। এবার মহুয়ার সদস্যপদ কেড়ে নেওয়ার সুপারিশ করা হলো।