ভারতের জম্মু–কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে যাচ্ছেন ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) নেতা ওমর আবদুল্লাহ্। আগামীকাল বুধবার তাঁকে শপথবাক্য পাঠ করাবেন উপরাজ্যপাল মনোজ সিনহা। উপরাজ্যপাল গতকাল সোমবার ওমরকে চিঠি দিয়ে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আগের দিন রোববার জম্মু–কাশ্মীরে জারি থাকা রাষ্ট্রপতির শাসনের অবসান ঘটানো হয়।
ওমর আবদুল্লাহ্ এর আগেও জম্মু–কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তবে তখন সেটা ছিল পূর্ণ রাজ্য। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়ার পর এটাই বিধানসভার প্রথম নির্বাচন। সেই নির্বাচনে জিতে এবার তিনি মুখ্যমন্ত্রী হবেন খণ্ডিত জম্মু–কাশ্মীরের।
শ্রীনগরে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ওমর ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সব শরিককে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কংগ্রেস, সিপিএম এই ভোটে এনসির মিত্র ছিল। পিডিপি আলাদা লড়লেও তারাও ‘ইন্ডিয়া’র সঙ্গী। আমন্ত্রিত তারাও। যেমন আমন্ত্রিত আম আদমি পার্টি (আপ)। তারা একটি আসনে জিতেছে। ডোডায়। ওমরের সরকারকে আপ নিঃশর্ত সমর্থন দিচ্ছে। তারা মন্ত্রিসভায়ও যোগ দিতে আগ্রহী। ওমর চাইছেন, শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানকে বিরোধী শক্তির প্ল্যাটফর্ম করে তুলতে।
ভোটে এনসি–সিপিএম–কংগ্রেস জোট নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেলেও মন্ত্রিসভা গঠনের বিষয়ে ওমর দুশ্চিন্তায় ছিলেন। কারণ, জম্মু অঞ্চল থেকে জোটের কোনো হিন্দু প্রার্থী জিততে পারেননি। সেই দুশ্চিন্তা দূর করেছেন ৪ স্বতন্ত্র। তাঁরা হলেন পেয়ারেলাল শর্মা, সতীশ শর্মা, চৌধুরী মহম্মদ আক্রম ও রামেশ্বর সিং। জম্মু ও কাশ্মীরের ভারসাম্য ঠিক রাখতে জম্মুর হিন্দুদের মন্ত্রী করা সহজ হবে। মন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা সিপিএমের প্রবীন নেতা ইউসুফ তারিগামিরও। তবে আপের বিধায়ক মন্ত্রী হবেন কি না, এখনো নিশ্চিত নয়। কংগ্রেস অবশ্যই মন্ত্রিত্ব চায়।
মন্ত্রিসভা গঠনের আগে উপরাজ্যপাল পাঁচজনকে মনোনীত করবেন কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়। ভোটের আগে বিজেপি যদিও সেই পাঁচজন সদস্যের নাম জানিয়েছিল। প্রত্যেকেই বিজেপির নেতা। তাঁদের প্রত্যেকের ভোটদানের অধিকারও থাকবে। তখন থেকেই তাঁদের নিয়োগকে কেন্দ্র করে বিজেপির সঙ্গে বিরোধীদের চাপান–উতোরের সূত্রপাত।
বিরোধীদের দাবি, নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেই মনোনীত সদস্য নিযুক্ত হওয়া উচিত। যেমন হয় সংসদে। রাজ্য পুনর্গঠন আইনে যদিও সেই বিষয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। মনোনীতদের ধরলে বিধানসভার বহর ৯০ থেকে বেড়ে ৯৫ হয়। সরকার গড়া ও আস্থা ভোটে জিততে প্রয়োজন ৪৮ জনের সমর্থন। সে ক্ষেত্রে সরকারের রয়েছে ৫৫ জনের সমর্থন।
বিধানসভায় সদস্য মনোনয়ন নিয়ে বিরোধীরা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল। অভিষেক মনু সিংভির আবেদন অবশ্য গতকাল সোমবার সুপ্রিম কোর্ট গ্রাহ্য করেননি। আবেদনকারীকে বলা হয়, উপরাজ্যপাল এখনো কাউকে মনোনয়ন করেননি। তাই এই বিষয়ে আগে জম্মু–কাশ্মীর হাইকোর্টে আবেদন জানাতে হবে। হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ না দিলে তখন সুপ্রিম কোর্টে আসা যাবে।
জম্মু–কাশ্মীরের নতুন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহর হাল দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতো হবে কি না, সেই জল্পনা ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। ওমরকে কেজরিওয়াল এ কথাও বলেছেন, কীভাবে ‘হাফ স্টেট’ চালাতে হয় সেই পরামর্শ তাঁকে দিতে তিনি প্রস্তুত। অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে রাজি। কিন্তু ওমর সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে যা বলেছেন তাতে মনে হচ্ছে, শুরু থেকেই তিনি দিল্লির সঙ্গে সংঘাতের রাস্তায় হাঁটতে চান না। বরং সহযোগিতার মধ্য দিয়ে চেষ্টা করবেন মানুষের প্রয়োজন মেটাতে।
ওমর বিলক্ষণ জানেন, দিল্লির মতো জম্মু–কাশ্মীরও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। সেখানকার ক্ষমতা মুখ্যমন্ত্রী ও উপরাজ্যপালের মধ্যে বিভাজিত, তা ছাড়া দিল্লির মতো জম্মু–কাশ্মীরের রাজস্ব উদ্বৃত্ত এলাকা নয়। কেন্দ্রের ওপর নির্ভর না করে তাঁদের উপায় নেই। সে জন্য মানুষের স্বার্থে শুরু থেকে সংঘাতে না গিয়ে সহযোগিতাই তিনি শ্রেষ্ঠ পন্থা মনে করছেন।
ওমর অবশ্য চান, যত দ্রুত সম্ভব পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা যেন ফিরে আসে। তবে সে জন্য সংঘাতে গেলে লাভ নেই। সংঘাতের অর্থ জনজীবনে নতুন করে অশান্তি সৃষ্টি। বিজেপি নেতা রাম মাধব বলেই দিয়েছেন, রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার আগে কেন্দ্রকে নিশ্চিত হতে হবে যে সংঘাত ও সংঘর্ষপূর্ণ সেই পুরোনো দিনগুলো আর ফেরত আসবে না। উপত্যকার রায় ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদের বিরুদ্ধে হলেও সেই প্রশ্নেও এনসি তাড়াহুড়া করতে রাজি নয়। লড়াইটা তারা রাজনৈতিক স্তরে না নিয়ে আইনি পর্যায়ে মীমাংসায় বেশি আগ্রহী। সে জন্য ভবিষ্যতে কেন্দ্রে সরকার বদলের অপেক্ষায় তারা থাকবে।
উপত্যকার মানুষের পাশাপাশি জম্মুর মানুষেরও যে সমর্থন এনসি পেয়েছে, সেই ‘গুড উইল’ তারা নষ্ট হতে দিতে চায় না। সেই কারণে ওমরের বাবা ফারুক আবদুল্লাহ জম্মুতে বসবাসরত কাশ্মীরি পণ্ডিতদের আহ্বান জানিয়েছেন উপত্যকায় ফেরত আসতে। ফারুক তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। জানিয়েছেন, নতুন সরকার তাঁদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করবে।
সরকার গড়ার আগে এনসির এই ইতিবাচক বার্তা কেন্দ্র কতটা আমল দেয়, তা দেখার। রাজনৈতিক মহল সে জন্য অপেক্ষায় থাকতে চাইছে। প্রথম বার্তা আসবে উপরাজ্যপালের দিক থেকে। সদস্য মনোনয়নের মধ্য দিয়ে। দেখার এটাই, নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে উপরাজ্যপাল পাঁচ মনোনীত সদস্য নিযুক্ত করেন কি না। করলে এক বার্তা, না করলে অন্য রকম। এ কথাও শোনা যাচ্ছে, কেন্দ্র উপরাজ্যপালের বদলও ঘটাতে পারে। সেটা হলে মুখ্যমন্ত্রী ও উপরাজ্যপাল দুজনকেই নতুন ক্যানভাস দেওয়া হবে, যাতে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় দুজনেই শুরু করতে পারেন।