১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যে যাঁরা আসামে প্রবেশ করেছেন, তাঁরা ভারতীয় নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবেন। তবে নাগরিকত্বের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ আজ বৃহস্পতিবার এই আদেশ দিয়েছেন।
২০১২ সালে আসামের নাগরিক সংগঠন আসাম সম্মিলিত মহাসংঘের করা একটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই আদেশ দেন। আবেদনে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের ৬–এ ধারা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল। ধারাটি ১৯৮৫ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও আসামের আন্দোলনকারী রাজনৈতিক ও ছাত্রসংগঠনের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘আসাম চুক্তি’র প্রধান ধারা। এটিকে ‘অসাংবিধানিক’ চিহ্নিত করে এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টকে আপত্তির কথা জানিয়েছিল মহাসংঘ।
আবেদনকারীদের বক্তব্য
আসামে অনুপ্রবেশ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলছে। সেই বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে আসাম সম্মিলিত মহাসংঘের আবেদনে বলা হয়, ৬–এ ধারা বৈষম্যমূলক, বিধিবহির্ভূত এবং খামখেয়ালের বশে তৈরি করা করা হয়েছে। তাদের যুক্তি, আসামে অবৈধ অভিবাসীদের নিয়মিত নাগরিক করার জন্য ভারতের অন্য প্রদেশের তুলনায় পৃথক কাট-অফ (প্রবেশের নির্দিষ্ট তারিখ) বিধানটি অন্যায্য ছিল।
তাই ৬–এ ধারাকে ‘অসাংবিধানিক’ চিহ্নিত করে আসাম সম্মিলিত মহাসংঘ। তাদের যুক্তি, এটি ভারতীয় সংবিধানের ধারা ১৪, ২১ ও ২৯-কে লঙ্ঘন করছে।
ভারতের সংবিধানের ১৪ ধারা অনুযায়ী, সব ধরনের বৈষম্য অর্থাৎ জাতি, বর্ণ, ধর্ম, জন্মস্থান ও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যবিরোধী। সংবিধানের এই ধারায় সব নাগরিক আইনের চোখে সমান এবং আইন দ্বারা সুরক্ষিত।
সংবিধানের ২১ ধারায় বলা হয়েছে, আইন নির্দেশিত পথে ভারতের প্রতিটি নাগরিকের জীবনের ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার সুরক্ষিত করতে রাষ্ট্র বাধ্য। ২৯ ধারায় সংখ্যালঘুদের সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষাগত অধিকার সুরক্ষিত করার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।
১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগের ভোটার তালিকার ওপর নির্ভর না করে ১৯৫১ সালের এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস) থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আসামের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) গঠনের পক্ষে আবেদনে করেছিল মহাসংঘ। তাদের ভাষ্য ছিল, এনআরসি ‘হালনাগাদ’ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়ার লক্ষ্যে আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হবে। পরবর্তী সময়ে আসামের অন্যান্য বেশ কিছু সংস্থাও ৬–এ ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে পিটিশন করে।
সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য
প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি সূর্য কান্ত, বিচারপতি এম এম সুন্দ্রেশ, বিচারপতি জে বি পারদিওয়ালা ও বিচারপতি মনোজ মিশ্র। তাঁরা ৬–এ ধারা অক্ষুণ্ন রেখেছেন।
তবে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। বিচারপতি জে বা পারদিওয়ালা বিপরীত মত পোষণ করেন। তিনি বলেন, ধারা ৬–এ ‘অসাংবিধানিক’।
প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় রায়ে বলেন, আসাম চুক্তি ছিল অবৈধ অভিবাসনের সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান। আর তার আইনি সমাধান সূত্র দেওয়া হয়েছিল ৬–এ ধারায়।
সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতে, বিধানটি কার্যকর করার জন্য সংসদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রয়েছে। তাঁরা মনে করেন, ৬–এ ধারা স্থানীয় জনগণের সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সঙ্গে মানবিক উদ্বেগের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য তৈরি করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গ
সুপ্রিম কোর্টের অধিকাংশ বিচারপতি মনে করেন, ভারতের অনেক রাজ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে। তবে আসামকে পৃথকভাবে দেখার চেষ্টা যুক্তিসংগত। কারণ, আসামের স্থানীয় জনসংখ্যার মধ্যে অভিবাসীর সংখ্যা অন্যান্য সীমান্ত রাজ্যের তুলনায় বেশি। আসামে ৪০ লাখ অভিবাসী রয়েছে।
চারজন বিচারপতি বলেন, ১৯৭১ সালের ‘কাট-অফ’ তারিখটি যৌক্তিক ছিল। কারণ, এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরুর দিন।
প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় রায়ে আরও বলেন, একটি রাজ্যে বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর উপস্থিতির অর্থ এই নয় যে সংবিধানের ২৯(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। আবেদনকারীদের প্রমাণ করতে হবে, অন্য জাতিগোষ্ঠীর উপস্থিতির কারণে একটি জাতিগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা করতে সক্ষম হচ্ছে না।
আদালতের সিদ্ধান্ত
বিচারপতি কান্ত ধারা ৬–এ সম্পর্কে সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত পড়ে শোনান। এতে বলা হয়, যাঁরা ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারির আগে আসামে প্রবেশ করেছিলেন, তাঁদের ভারতীয় নাগরিক হিসেবে যেমন গণ্য করা হয়, তেমনই হবে। তবে ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারির পর থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যে যাঁরা আসামে প্রবেশ করেছেন, তাঁদের যোগ্যতার মানদণ্ড পূরণ করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে নাগরিকত্বের জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। তবে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বা এরপরে যাঁরা আসামে প্রবেশ করেছেন, তাঁদের অবৈধ অভিবাসী ঘোষণা করে ফেরত পাঠাতে হবে।
আসামে অনুপ্রবেশকারী ও অভিবাসী সমস্যার কী হবে
১৯৫৫ সালের আইন এবং ১৯৮৫ সালের আসাম চুক্তির ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের আজকের আদেশের পরে আসামে অভিবাসী নিয়ে যে বিতর্ক, সেই বিতর্ক বন্ধ হয়ে যাবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এ বিষয়ে আসামের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি শুধু আইনি নয়, এটি রাজনৈতিকও বটে। যতক্ষণ না রাজনৈতিক মীমাংসা হবে, ততক্ষণ এই বিতর্ক চলবে। বারবার নির্বাচনে এটি ইস্যু হিসেবে ফিরে আসবে।