স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের ‘সর্বনাশের কারণ’ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ১০ বছর ধরে যাঁকে খাড়া করে আসছেন, ক্ষমতায় এলে পররাষ্ট্রনীতিতে সেই জওহরলাল নেহরুর আদর্শকেই আঁকড়ে ধরবে কংগ্রেস। গতকাল শুক্রবার প্রকাশিত দলের নির্বাচনী ইশতেহারে কংগ্রেস স্পষ্টভাবে এই অঙ্গীকার করেছে।
বিজেপি সরকারের গত ১০ বছরের পররাষ্ট্রনীতির কঠোর সমালোচনা করে ইশতেহারে কংগ্রেস বলেছে, স্বাধীনতার সময় থেকেই দেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয়েছে মতৈক্যের ভিত্তিতে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সহমতের সেই রীতি থেকে বেরিয়ে বিজেপি বহু সময় তার মতো করে নীতি গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে তা দেখা গেছে সাম্প্রতিক ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধের ক্ষেত্রে। শান্তিকামী দেশ শান্তির প্রবক্তা হিসেবে বিশ্বে ভারতের যে পরিচয় ছিল, কংগ্রেস তা আবার প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
কংগ্রেস যেদিন তার নির্বাচনী ইশতেহারে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় মোদি সরকারের নীতির সমালোচনা করছে, সেদিনই জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে এ নিয়ে পাস হওয়া প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত ছিল ভারত।
লক্ষণীয়, কংগ্রেস যেদিন তার নির্বাচনী ইশতেহারে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় মোদি সরকারের নীতির সমালোচনা করছে, সেদিনই জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে এ নিয়ে পাস হওয়া প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত ছিল ভারত। ওই প্রস্তাবে ইসরায়েলকে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ ও তাদের যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য জবাবদিহির আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে।
মানবাধিকার পরিষদের ৪৭ সদস্যদেশের মধ্যে বাংলাদেশসহ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে ২৮টি দেশ। বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানিসহ ছিল ৬টি দেশ। ১৩টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। তাদের মধ্যে অন্যতম ভারত। গতকাল শুক্রবার ভারত জাতিসংঘে কেন ওই ভূমিকা নিল, তার কোনো জবাব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আজ শনিবারও দেয়নি।
মোদির আমলে গৃহীত পররাষ্ট্রনীতি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করছে বলে কংগ্রেস বহুবার অভিযোগ জানিয়েছে। সম্পর্ক নষ্টের পেছনে শাসক দলের অভ্যন্তরীণ নীতিকেও দায়ী করে আসছে কংগ্রেস। ইশতেহারে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। কংগ্রেস বলেছে, প্রতিবেশীদের দিকে তারা বিশেষ নজর দেবে। নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে সম্পর্কহানি নিয়ে কংগ্রেস অনেকবার সরব হয়েছে। ইশতেহারে তারা বলেছে, এই দুই দেশের সঙ্গে বিশেষ করে সম্পর্ক দৃঢ় করাই হবে তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য। সেই সম্পর্ক তৈরি করা হবে পারস্পরিক মঙ্গলের কথা ভেবেই।
ইশতেহারে বাংলাদেশ প্রসঙ্গও লিখেছে কংগ্রেস। যেমন উল্লেখ করেছে মালদ্বীপের কথাও। মালদ্বীপের আদলে বাংলাদেশে সম্প্রতি ‘ইন্ডিয়া আউট’ স্লোগান শোনা যাচ্ছে। ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রচার চালানো হচ্ছে। এই দুই বন্ধুদেশে ভারত-বিরোধিতা কংগ্রেসকে চিন্তায় রেখেছে।
ইশতেহারে তাই কংগ্রেস বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও বাংলাদেশ—দুটিই বৃহৎ জনসমষ্টির দেশ। ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক তারা বাড়িয়ে দেবে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে। সেই সম্পর্ক নতুন করে তৈরি করা হবে। তামিলদের সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক সমস্যা মেটাতে সচেষ্ট হবে। মিয়ানমারের জনগণের রাজনৈতিক ও মানবাধিকার রক্ষায় তৎপর হবে।
ইশতেহারে তাই কংগ্রেস বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও বাংলাদেশ—দুটিই বৃহৎ জনসমষ্টির দেশ। ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক তারা বাড়িয়ে দেবে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ভারতের অবস্থান ১০ বছর ধরেই নিম্নগামী। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবাধিকার রক্ষার মতো বিষয়ে ভারতের অবস্থান দ্রুত নেমে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক স্বৈরাচার হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে ভারতকে। এই অধোগমন নিয়ে কংগ্রেস বারবার সরব।
ইশতেহারে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের নষ্ট হয়ে যাওয়া ভাবমূর্তি ফেরাতে কংগ্রেস সব রকমভাবে চেষ্টা করবে। বিজেপি সরকার যে ক্ষতি করেছে, তা মেরামত করা হবে।
মোদি সরকার জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে এত কাল যা করছে, কংগ্রেস তারও বড় সমালোচক। ইশতেহারেও তারই প্রতিফলন ঘটেছে। কংগ্রেস বলেছে, জাতীয় নিরাপত্তা বুক বাজিয়ে নিশ্চিত করা যায়নি। বাড়াবাড়ি রকমের দাবি জানিয়েও যায় না। জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করা যায়নি। সীমান্তে প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি বাড়িয়ে তুলে।
কংগ্রেস বলেছে, চীন সীমান্তে দুই দেশের সেনাদের যে অবস্থান ছিল, সেই পুরোনো অবস্থান ফিরে পেতে তারা কাজ করবে। দুই দেশের সেনারা যে যে এলাকায় টহল দিত, ভারতের সেনারা যাতে সেই টহলদারির অধিকার ফিরে পান, তা নিশ্চিত করা হবে। সেই লক্ষ্যে প্রয়োজনে চীন নীতিতে বদল আনা হবে।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতির বেশির ভাগ পাকিস্তানকেন্দ্রিক। সবচেয়ে স্পর্শকাতরও। সেই পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অনেক দিন ধরেই বন্ধ। কোনো বিষয়ে কোনো আলোচনা নেই। কংগ্রেসের ইশতেহারে পাকিস্তান প্রসঙ্গ সংক্ষিপ্ত।
এতে বলা হয়েছে, সীমান্ত সন্ত্রাস বন্ধে পাকিস্তান কতটা আন্তরিক, সম্পর্কের অগ্রগতি প্রধানত তার ওপরই নির্ভর করছে। পররাষ্ট্রনীতিতে এই ক্ষেত্রে বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেসের অমিল নেই বললেই চলে।