ভারতে ‘বৈবাহিক ধর্ষণের’ ঘটনাকে অপরাধ বলে ঘোষণা করার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই দাবি উঠছে। এ নিয়ে সোচ্চার থাকা মানুষেরা এখন সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন। তবে দেশটির সরকার বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ ঘোষণার বিরুদ্ধে। তারা বলছে, একে অপরাধ ঘোষণা করাটা অত্যন্ত কঠোর সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে।
ভারতে কোনো পুরুষ যদি তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং স্ত্রী যদি ১৮ বছরের বেশি বয়সী হন, তবে সেটি বৈবাহিক ধর্ষণ বলে বিবেচনা করা হয় না। এ ক্ষেত্রে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের পুরোনো আইন ধরে রেখেছে দেশটি। যদিও অনেক দেশ ইতিমধ্যে আইনটি সংশোধন করেছে। যেমন ১৯৯১ সালে যুক্তরাজ্য বৈবাহিক ধর্ষণকে বেআইনি ঘোষণা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের সব কটিতেই এটি অবৈধ।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) ২০২১ সালের একটি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রায় ৪০টি দেশে এখনো ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’–বিরোধী কোনো আইন নেই।
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, যৌন সম্পর্ক স্থাপনের জন্য স্ত্রীর ওপর জোরজবরদস্তি করার দায়ে একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। তবে এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে ধর্ষণ বিবেচনা করে সাজা দেওয়া হলে ‘দাম্পত্য সম্পর্কের ওপর গুরুতর প্রভাব’ পড়বে। বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটির ওপরও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে।
ভারতে অধিকারকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে ঔপনিবেশিক আমলের আইনটি সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছেন। দেশটির শীর্ষ আদালতে বর্তমানে এ–সংক্রান্ত আবেদনের ওপর শুনানি চলছে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এসব আবেদনের বিরোধিতা করছে ভারত সরকার।
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, যৌন সম্পর্ক স্থাপনের জন্য স্ত্রীর ওপর জোরজবরদস্তি করার দায়ে একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। তবে এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে ধর্ষণ বিবেচনা করে সাজা দেওয়া হলে ‘দাম্পত্য সম্পর্কের ওপর গুরুতর প্রভাব’ পড়বে। বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটির ওপরও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে।
ভারত সরকার মনে করে, বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করাটা অতিমাত্রায় কঠোর ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত হতে পারে। সরকার লিখিত হলফনামার মাধ্যমেও এ বিষয়ে তার অবস্থান পরিষ্কার করেছে।
বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ বিবেচনার পক্ষে সোচ্চার থাকা মানুষেরা বলছেন, সরকারের যুক্তি আশ্চর্যজনক কিছু নয়। তবে এটা অত্যন্ত পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বসবাসকারী নারীর জন্য ‘পশ্চাৎপদতার’ নামান্তর।
ফৌজদারি আদালতের বিচারপতি নাতাশা ভারদ্বাজ বলেন, ‘আমাদের দেশের নারীদের যৌন সহিংসতার শিকার হওয়াকে আমরা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত করেছি।’
গত জুলাই মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার দেশটির ১৬৪ বছরের পুরোনো দণ্ডবিধি বাতিল করে নতুন ফৌজদারি আইন চালু করেছে। তবে বৈবাহিক ধর্ষণবিরোধী আইন প্রণয়নের বিষয়টি কাগজে–কলমেই রয়ে গেছে।
কয়েক বছর ধরে নারীর প্রতি সহিংসতার উচ্চ হার ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে ভারত। আলোচিত কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে বিক্ষোভ হতে দেখা গেছে। এমনকি এসব ঘটনা নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনামও হয়েছে।
ভারত সরকার এমন সময়ে বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ ঘোষণার বিরুদ্ধে তাদের আনুষ্ঠানিক মতামত দিল, যখন পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় এক নবীন চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার বিচার চেয়ে আন্দোলন চলছে।
দুই মাস আগে ওই ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ঘটে। ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর আনুষ্ঠানিক একটি সূত্র সিএনএনকে বলেছে, এ ঘটনায় গত সোমবার এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ ঘোষণা করার বিষয়ে ভারত সরকারের বক্তব্য, দাম্পত্য সম্পর্কে নারীর সম্মতির বিষয়টি সুরক্ষিত থাকতে হবে। তবে স্বামী-স্ত্রী যে কারও একে অপরের প্রতি যৌক্তিক যৌন চাহিদা থাকতে পারে। যদিও সে আকাঙ্ক্ষা থাকার কারণে কেউ তাঁর স্ত্রীকে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করার অধিকার রাখেন না। তবে বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে ও বাইরে এ ধরনের আচরণের শাস্তি এক হতে পারে না।
ভারত সরকার দাবি করেছে, বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে সম্মতির বিষয়টি সুরক্ষিত রাখতে যৌন ও পারিবারিক সহিংসতাবিরোধী প্রচলিত আইনগুলোই যথেষ্ট।
বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণার জন্য আদালতে আবেদন জানানো ব্যক্তিদের একজন মারিয়াম ধাওয়ালে। তিনি ভারতের নারী অধিকার সংগঠন অল ইন্ডিয়া ডেমোক্রেটিক উইমেনস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব।
ধাওয়ালে মনে করেন, বৈবাহিক সম্পর্কের ভেতরে কিংবা বাইরে—দুই ক্ষেত্রেই সম্মতি কোনো আলাদা বিষয় নয়। সম্মতি সম্মতিই। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে নারীদের স্বাধীন মানুষ হিসেবে, স্বাধীন নাগরিক হিসেবে ভাবা হয় না। তিনি স্বামীর কাছে একধরনের অনুষঙ্গের মতো। তিনি অধস্তন, তাঁর তেমন করে আলাদা কোনো পরিচিতি থাকে না।’
ধাওয়ালে আরও বলেন, সহিংসতার শিকার হয়ে যেসব নারী তাঁর সংগঠনের কাছে সহযোগিতা চাইতে আসেন, সেসব সহিংসতার অনেকগুলোই বৈবাহিক ধর্ষণের। তবে প্রায়ই দেখা যায়, তাঁরা তাঁদের অভিযোগগুলো জানাতে চান না। কারণ, তাঁরা জানেন, কেউ তাঁদের বিশ্বাস করবেন না এবং অভিযোগ অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করবেন না।
ফৌজদারি আদালতের বিচারপতি নাতাশা ভারদ্বাজ মনে করেন, মানুষের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনা আইন পরিবর্তনের চেয়ে বেশি কঠিন। তবে তাঁর মতে, আইন পরিবর্তন প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে।
ভারদ্বাজ বলেন, ‘আপনি যতক্ষণ না বড় করে আওয়াজ তুলবেন যে কাজটা ঠিক হচ্ছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত এ প্রবণতার পরিবর্তন হবে না। কারণ, সংশ্লিষ্ট আইন না থাকার কারণে সহিংসতাকে মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।’
গত মে মাসে মধ্যপ্রদেশের একজন বিচারপতি স্বামীর বিরুদ্ধে এক নারীর করা অভিযোগ খারিজ করে দেন। ওই নারী অভিযোগ করেছিলেন, স্বামী তাঁর সঙ্গে ‘অস্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক’ স্থাপন করেছেন। তখন বিচারপতি দেশটির আইনে বৈবাহিক ধর্ষণকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। বিচারপতি বলেন, এসব ক্ষেত্রে ‘স্ত্রীর সম্মতির বিষয়টি অমূলক হয়ে পড়েছে।’
স্বামীর যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া আরেক নারী এর আগে সিএনএনকে বলেছিলেন, তিনি মনে করেন, বাহিক ধর্ষণকে অপরাধ বলে বিবেচনা করা উচিত। এতে নারীরা শক্তি পাবেন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জোরালোভাবে দাঁড়াতে পারবেন।’
অপর একজন নারী সিএনএনকে বলেছেন, তিনি স্বামীর কাছ থেকে আলাদা হয়ে যেতে ভয় পান। কারণ, তিন সন্তানের ভরণপোষণের উপায় তাঁর নেই। তিনি মনে করেন, বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ ঘোষণা করা হলে তাঁর মতো যেসব নারীর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, তাঁরা উপকৃত হতেন।
২০১৭ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে সম্মতি নেওয়ার বিষয়ে দাম্পত্যসঙ্গীর বয়সসীমা ১৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ১৮ বছর করেন। অর্থাৎ, ১৮ বছরের কম বয়সী স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সম্মতি ছাড়া যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে না। আগে তা ১৫ বছরে সীমাবদ্ধ ছিল।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জায়না কোঠারি সিএনএনকে বলেন, ওই সময়েও ভারত সরকার একই যুক্তি দেখিয়েছিল। সম্মতি নেওয়ার ক্ষেত্রে বয়সসীমা বাড়ানোর বিরোধিতা করে তারা বলেছিল, এতে বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠান হুমকিতে পড়বে। তবে সুপ্রিম কোর্ট তা আমলে নেননি।
বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করার ক্ষেত্রে ভারত সরকার এবং পুরুষের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর মধ্যে একটি বড় উদ্বেগ কাজ করছে। দুই পক্ষেরই আশঙ্কা, বৈবাহিক ধর্ষণবিরোধী আইন পাস হলে নারীরা তাঁদের স্বামীদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ করতে পারেন।
তবে আইনজীবী কোঠারি তা মনে করেন না। তাঁর মতে, যৌন নিপীড়নবিরোধী আইন প্রচলিত থাকার পরও নারী ভুক্তভোগীদের অভিযোগ জানাতে কাঠখড় পোহাতে হয়। বৈবাহিক ধর্ষণবিরোধী আইন পাস হলেই যে তাঁরা সহজে অভিযোগ জানিয়ে সুবিধা আদায় করতে পারবেন, বিষয়টা এমন নয়।