কাশ্মীরের কুপওয়ারায় জঙ্গি হামলার পর সেই এলাকা পরিদর্শন করেন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা। ১৫ জুলাই
কাশ্মীরের কুপওয়ারায় জঙ্গি হামলার পর সেই এলাকা পরিদর্শন করেন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা। ১৫ জুলাই

কাশ্মীরে জামায়াতকে নির্বাচনে এনে কী অর্জন করতে চায় মোদি সরকার

ভারতের বিরোধী দল কংগ্রেসের নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদেরা বলেছেন, কেন্দ্রে নতুন সরকার গঠনের পর জম্মু–কাশ্মীরে ৪৯ দিনে ১৪টি সন্ত্রাসী হামলায় ১৫ জওয়ান নিহত হয়েছেন। এটা গভীর উদ্বেগের বিষয়। সরকারের উচিত, জম্মু–কাশ্মীরনীতি পর্যালোচনা করা।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন বলছে, জম্মু–কাশ্মীরে গত ৩২ মাসে ৫০ জনের বেশি ভারতীয় সেনাসদস্য জঙ্গি হামলায় নিহত হয়েছেন। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারের পর কেন্দ্রশাসিত ভূস্বর্গ শান্তির নিকেতন হয়ে উঠেছে বলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর দাবি কতটা বিশ্বাসযোগ্য, সেই প্রশ্ন উঠেছে।

তার চেয়েও বড় কথা, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে জম্মু–কাশ্মীর বিধানসভার ভোট গ্রহণের সঙ্গে এই হঠাৎ সন্ত্রাসবৃদ্ধির কোনো যোগসাজশ আছে কি না, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অলিন্দে এখন তা নিয়ে চলছে জোর চর্চা।

জামায়াত ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে দূতের কাজ করা আপনি পার্টির নেতা আলতাফ বুখারি উপত্যকার সাংবাদিকদের কাছে নিজের ভূমিকার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, দিল্লিতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে জামায়াত প্রতিনিধিদের একাধিক বৈঠক হয়েছে।

সরকারের একটি মহলের ধারণা, সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ বৃদ্ধির সম্ভাব্য লক্ষ্য ওই নির্বাচন বাতিল করা। সে জন্য সক্রিয় সীমান্তপারের প্রতিবেশী পাকিস্তানের শাসক মহল যদিও বারবার তাদের ‘নন স্টেট অ্যাক্টর্স’ বলে অভিহিত করে এসেছে।

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছেন, এই বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে জম্মু–কাশ্মীর বিধানসভার ভোট করাতে হবে। সেই ঘোষণার পর জঙ্গি হামলার সংখ্যা ও তীব্রতা যেমন বেড়েছে, তেমনই রাজনৈতিক মহলে শুরু হয়েছে নানা তৎপরতা। এই তৎপরতার উল্লেখযোগ্য দিক দীর্ঘ ৩৭ বছর পর সাবেক ওই রাজ্যের জামায়াত–ই–ইসলামির নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ।

২০১৯ সালের আগস্টে জম্মু–কাশ্মীর দ্বিখণ্ডিত হয় ও সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজ হয়। সেই বছরের ফেব্রুয়ারিতে জামায়াত–ই–ইসলামিকে কেন্দ্রীয় সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। শোনা যাচ্ছে, নরেন্দ্র মোদি সরকার সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার কথা বিবেচনা করছে, যাতে জামায়াত–ই–ইসলামি বিধানসভার ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে।

জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভা ভোটে জামায়াত-ই-ইসলামি শেষবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল ১৯৮৭ সালে। সেই ভোটে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠেছিল। তারপর তারা জঙ্গি লড়াইয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ১৯৯৮ সালে জামায়াত ঘোষণা দিয়ে জঙ্গিবাদী আন্দোলন থেকে সরে আসে।

সরকার স্বীকার বা অস্বীকার না করলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অলিন্দে শোনা যাচ্ছে আরও বেশ কিছু কথা। যেমন ভোটে অংশ নেওয়া নিয়ে জামায়াত নেতারা কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বেশ কয়েক দফা আলোচনা করেছেন। সেই আলোচনার ভিত্তিতে জামায়াতের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে এবং এই বিষয়ে দূতের ভূমিকায় নেমেছেন জম্মু–কাশ্মীরের আপনি পার্টির নেতা আলতাফ বুখারি।

আলতাফ বুখারির বয়স ৬৬। তিনি ছিলেন পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) শীর্ষস্থানীয় নেতা। মেহবুবা মুফতির নেতৃত্বাধীন ওই দল যখন বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাজ্যে সরকার গড়েছিল, আলতাফ বুখারি ছিলেন সেই মন্ত্রিসভার সদস্য। এরপর ২০১৮ সালে সরকার পতনের পর বিজেপি ধীরে ধীরে সেখানে একটি বিকল্প রাজনৈতিক দল গঠনে উদ্যোগী হয়। পিডিপি, ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) ও কংগ্রেসের দলছুট রাজনীতিকদের মদদ দিয়ে ২০২০ সালে গড়ে তোলা হয় আপনি পার্টি। সেই থেকে দলের সভাপতি আলতাফ বুখারি।

বিজেপির লক্ষ্য, জম্মু–কাশ্মীরে এনসি–পিডিপি–কংগ্রেসকে বাইরে রেখে শাসনক্ষমতা দখল করা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সে জন্য বারবার বলেছেন, কাশ্মীরকে বরবাদ করেছে তিনটি পরিবার। আবদুল্লাহ, মুফতি ও গান্ধী। এই তিন পরিবারের হাত থেকে তিনি জম্মু–কাশ্মীরকে রক্ষা করবেন।

আলতাফ বুখারির আপনি পার্টি এবং সাবেক কংগ্রেস নেতা গুলাম নবী আজাদের তৈরি আজাদ পার্টির সঙ্গে হাত মেলালেও বিজেপি এখনো তার লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি। পঞ্চায়েত ও পৌরসভা ভোটে ওই তিন পারিবারিক দলেরই রমরমা ছিল। লোকসভা ভোটে উপত্যকায় বিজেপি এবার প্রার্থী দেয়নি। কিন্তু পূর্ণ মদদ দিয়েছিল তার সহযোগীদের। যদিও তিন আসনের একটাতেও তারা দাঁত ফোটাতে পারেনি। এমনকি লাদাখের আসনটিতেও বিজেপি এবার হেরে গেছে।

কিন্তু সেই ভোট ঘিরে দুটি ঘটনা বিজেপিকে উৎসাহিত করে। প্রথমটি, এনসি ও পিডিপির মধ্যে আসন সমঝোতা না হওয়া। এর ফলে অনন্তনাগ–রাজৌরি কেন্দ্রে মেহবুবা মুফতি হেরে যান এনসির কাছে। দ্বিতীয় ঘটনা আরও গুরুত্বপূর্ণ। বারামুলায় ওমর আবদুল্লাহকে হারিয়ে দেন এক স্বতন্ত্র প্রার্থী, যিনি ইঞ্জিনিয়ার রশিদ নামে পরিচিত।
এই রশিদ রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় পাঁচ বছর ধরে দিল্লির তিহার জেলে বন্দী। তাঁর হয়ে প্রচার করেছিলেন তাঁরই দুই ছেলে। অর্থহীন ও জনবলহীন হওয়া সত্ত্বেও ওমর আবদুল্লাহর মতো সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও হেভিওয়েট নেতাকে তিনি দুই লাখের বেশি ভোটে হারিয়ে দেন।

এই ফল যথেষ্ট অর্থবহ। বিজেপির পক্ষে স্বস্তির যে উপত্যকায় গুপকর অ্যালায়েন্সের শরিক হওয়া সত্ত্বেও লোকসভা ভোটে এনসি–পিডিপির মধ্যে জোট না হওয়া। অন্যদিকে ইঞ্জিনিয়ার রশিদের জয় বুঝিয়ে দিচ্ছে, ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজের পর কেন্দ্রীয় সরকার উপত্যকা নিয়ে যে আখ্যান পেশ করে চলেছে, তা ভ্রান্ত।

রাজনৈতিক মহলের ধারণা, এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্র চাইছে বিধানসভা ভোটে জামায়াত–ই–ইসলামিকে নামাতে, যাতে একই সঙ্গে দুই লক্ষ্য পূরণ হয়। এনসি–পিডিপি–কংগ্রেসের প্রতিপত্তি খর্ব করে বিকল্প শক্তির উত্থান ঘটানো, যা দিল্লির ক্ষমতা জারি রাখবে।

জম্মু নিয়ে বিজেপির নেতৃত্বাধীন মোদি সরকারের বিশেষ চিন্তা নেই। বিধানসভা ও লোকসভা আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের পর জম্মু ও উপত্যকার আসন ব্যবধান কমে গেছে। জম্মুতে বিজেপি দুটি লোকসভা আসনেই জয়ী হয়েছে। তাদের চিন্তা উপত্যকা নিয়ে। বিকল্প শক্তির মাধ্যমে সেটি দখল করতে পারলে প্রথমবার তারা কোনো হিন্দুকে মুসলমানপ্রধান জম্মু–কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী করতে পারবে।

দ্বিতীয়ত, একদা যারা জঙ্গি লড়াইয়ে বিশ্বাসী ছিল, তাদের রাষ্ট্রীয় অনুগত করে তুলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের শক্তিহীন ও গণতন্ত্রী করে তোলা।

জম্মু–কাশ্মীর বিধানসভা ভোটে জামায়াত–ই–ইসলামি শেষবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল ১৯৮৭ সালে। সেই ভোটে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠেছিল। তারপর তারা জঙ্গি লড়াইয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ১৯৯৮ সালে জামায়াত ঘোষণা দিয়ে জঙ্গিবাদী আন্দোলন থেকে সরে আসে। তাতে সংগঠনে ভাঙন দেখা দেয়। জামায়াতের কট্টরপন্থী নেতা সৈয়দ আলী শাহ গিলানি সংগঠন ছেড়ে গড়ে তোলেন নতুন দল তেহরিক–ই–হুরিয়ত। পরবর্তী সময়ে সমভাবাপন্নদের নিয়ে তৈরি হয় হুরিয়ত কনফারেন্স।

জামায়াত ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে দূতের কাজ করা আপনি পার্টির নেতা আলতাফ বুখারি উপত্যকার সাংবাদিকদের কাছে নিজের ভূমিকার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, দিল্লিতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে জামায়াত প্রতিনিধিদের একাধিক বৈঠক হয়েছে।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য এই দাবি স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটাই করেনি। মন্ত্রণালয়ের এক সূত্র যদিও প্রথম আলোকে বলেছে, কোনো নিষিদ্ধ সংগঠন ভোটে দাঁড়াতে পারে না। জামায়াত এখনো নিষিদ্ধ। দ্বিতীয়ত, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দলকে ভারতীয় সংবিধান ও সংসদীয়–পরিষদীয় ব্যবস্থার প্রতি অনুগত থাকার কথা প্রকাশ্যে জানাতে হয়। তৃতীয়ত, হিংসার বিরুদ্ধে দৃঢ় ভূমিকা নিতে হবে।

জামায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলে সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠেয় জম্মু–কাশ্মীরের বিধানসভা নির্বাচন অন্য মাত্রা পাবে। দেখা যেতে পারে জোট রাজনীতির নতুন অধ্যায়।