মণিপুর রাজ্যের পরিস্থিতি কতটা অস্থিতিশীল ও ভঙ্গুর, আজ বৃহস্পতিবার সকালে তা আবার প্রমাণিত হয়েছে। আজ নিয়ে টানা ৯০ দিন চলা সহিংসতার মধ্যেই দক্ষিণ মণিপুরের সহিংসতায় বিধ্বস্ত দুই জেলা চূড়াচাঁদপুর ও বিষ্ণুপুরের মধ্যবর্তী পার্বত্য গ্রাম হাওলাই খোপিতে তাঁদের সমাজের ৩৫ জনকে গণকবর দিতে চেয়েছিলেন কুকি জনগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন উপজাতীয় সমাজের প্রতিনিধিরা। কিন্তু তীব্র প্রতিবাদ করেন মণিপুরি মেইতেই সমাজের মানুষ। তাঁদের বক্তব্য ছিল, ওই অঞ্চলকে একটি সমাধিস্থল বা কবরস্থানে পরিণত করা যাবে না।
কুকিদের গণকবর দেওয়া আর মেইতেইদের বিরোধিতা শেষ পর্যন্ত সহিংসতায় রূপ নেয়। বিষ্ণুপুর জেলার কাংভাই ও ফুগাকচাও এলাকায় সেনা, আধা সামরিক বাহিনী ও স্থানীয় পুলিশ যৌথ বাহিনীর সঙ্গে মেইতেইদের সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন বলে বিভিন্ন স্থানীয় সংবাদ সূত্রে জানা গেছে।
গত তিন মাসের সংঘর্ষে আদিবাসী সমাজের যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের ৩৫ জনের দাফন আজ করতে চেয়েছিলেন কুকিসহ অন্যান্য আদিবাসী সমাজের মানুষ। তবে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এই কর্মসূচি স্থগিত করে উপজাতি সমাজের নেতৃত্বদানকারী সংগঠন ইন্ডিজিনাস ট্রাইবাল লিডারস ফোরাম (আইটিএলএফ)।
আইটিএলএফের এক নেতা প্রথম আলোকে টেলিফোনে বলেন, ‘৯০ দিন আগে আদিবাসীদের মৃত্যুর যে মিছিল শুরু হয়েছে, তা মাথায় রেখেই গণকবরের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রশাসনের তরফে আমাদের জানানো হয়, এর ফলে উত্তেজনা বাড়তে পারে। এ কারণে আমরা কর্মসূচি স্থগিত করি। তারপরও আমাদের প্রবল হিংসা দেখতে হলো, আদিবাসী সমাজের মানুষ আক্রান্ত হলেন।’
আজ ভোরে মণিপুরের হাইকোর্ট চূড়াচাঁদপুর জেলার প্রস্তাবিত সমাধিস্থলে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেন। হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত বিচারপতি এম ভি মুরলিধরন এবং এ গুণেশ্বরের দুই সদস্যের বেঞ্চ পরিকল্পিত গণদাফন স্থগিত করে এলাকায় স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে প্রশাসনকে নির্দেশ দেন। শান্তি বজায় রাখতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে বলা হয়। ফলে সংঘর্ষের কয়েক ঘণ্টা আগেই জাতিগত ও সম্প্রদায়িক সহিংসতায় নিহত কুকি-জোমি সমাজের নিহত সদস্যদের গণদাফন স্থগিত করে দেওয়া হয়।
এরই মধ্যে আজ রাজ্যের একাধিক জেলায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। কাংভাই ও ফুগাকচাও এলাকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নিরাপত্তা বাহিনীকে কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে হয়। তারা গুলি চালিয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। মেইতেই সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী বিক্ষুব্ধ জনতার সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।
সহিংসতা রাজধানী ইম্ফলের দুই জেলায়ও ছড়িয়ে পড়ে। ইম্ফল পূর্ব ও ইম্ফল পশ্চিমের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা নতুন করে দিন ও রাতে কারফিউ জারি করেন।
গতকাল বুধবারই মেইতেই সমাজের তরফে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয়েছিল, বিষ্ণুপুর জেলায় যেখানে গণকবরের ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেই জায়গাকে কবরস্থানে পরিণত করতে দেওয়া হবে না। এই গণদাফনের ব্যবস্থাকারীদের ‘নারকো-টেররিস্ট’ (মাদক-সন্ত্রাসী) বলে মেইতেই সমাজের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়।
মেইতেইরা শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছে, কুকি নেতৃত্বাধীন আদিবাসী সমাজ মিয়ানমার থেকে মাদক চোরাচালান করছে মণিপুরের ভেতর দিয়ে বৃহত্তর ভারতে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা মণিপুরের স্থানীয় মানুষের জমি দখল করছে। সীমান্ত খোলা থাকার সুযোগে আদিবাসী সমাজের বড় অংশ (কুকি-চিন-জোমি) এসেছে মিয়ানমার থেকে। দুই পক্ষের মধ্যে বিবাদের এটি অন্যতম প্রধান কারণ। তিন মাস ধরে চলা সহিংসতায় এখন পর্যন্ত দেড় শর বেশি মানুষ মারা গেছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিষয়টি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেও সংসদে এখনো বিবৃতি দেননি।
হাইকোর্ট কুকি-জোমি সম্প্রদায়কে জানিয়েছেন, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে তারা গণদাফনের দাবি জানিয়ে সরকারের কাছে আবেদন করতে পারবে। তবে গণদাফনের জন্য আবেদন সাপেক্ষে আগে থেকে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে।