আদানি ইস্যুতে দ্বিতীয় দিনেও ভন্ডুল ভারতের সংসদ, সুপ্রিম কোর্টে মামলা

আদানি সাম্রাজ্যের কর্নধার গৌতম আদানি
ছবি: এএফপি

আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কারচুপির অভিযোগ তদন্তের দাবিতে শুক্রবারও ভন্ডুল হয়ে গেল ভারতীয় সংসদের দুই কক্ষের অধিবেশন। প্রথমে লোকসভা মুলতবি হলো বেলা দুইটা ও রাজ্যসভা আড়াইটা পর্যন্ত। বিরোধীদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত, অবিলম্বে আলোচনা ও উপযুক্ত তদন্তের দাবি মানা না হলে সংসদ চলতে দেওয়া হবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদনে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শেয়ারবাজারে কারচুপি ও জালিয়াতির গুরুতর অভিযোগ আনার পর থেকে ভারত সরকার এখনো নীরব। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন কিংবা শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক ‘সেবি’র চেয়ারম্যান—কেউই একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। অথচ হিনডেনবার্গ রিপোর্ট পেশ হওয়ার পর থেকে লাগাতার ঘটে চলেছে আদানি গোষ্ঠীর সব সংস্থার শেয়ারের দরপতন।

এ অবস্থায় কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত, আগামী সোমবার সারা দেশের সব রাজ্যে জীবনবিমা করপোরেশন (এলআইসি) ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার অফিসের বাইরে বিক্ষোভ সমাবেশ করা হবে। আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যাবতীয় অভিযোগের তদন্তের নির্দেশের দাবি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে এক জনস্বার্থ মামলাও করা হয়েছে। আবেদনে বলা হয়েছে, দেশের সাধারণ মানুষের সঞ্চয় পড়ে গেছে প্রবল ঝুঁকির মুখে।

প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেলেও কেন ভারত সরকার একটি শব্দও উচ্চারণ করছে না, বিরোধীদের বিস্ময় সেখানেই। এই নীরবতার পেছনে বিরোধীরা দায়ী করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। গুজরাটি প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে গুজরাটি শিল্পপতি গৌতম আদানির সখ্য সুবিদিত হওয়ায় বিরোধীদের আক্রমণের তির মোদির দিকেই ধাবিত। কংগ্রেস মুখপাত্র জয়রাম রমেশ শুক্রবার বলেন, এলআইসি, স্টেট ব্যাংক ও অন্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে আদানি গোষ্ঠীকে লগ্নিতে বাধ্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। একমাত্র নিরপেক্ষ তদন্তই এই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে বাঁচাতে পারে, যেখানে কোটি কোটি ভারতবাসীর সঞ্চয় রয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার বিরোধী দলগুলোর অধিকাংশ একজোট হয়ে সংসদে আলোচনা ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিতে সহমত হয়েছিল। রাজ্যসভার বিরোধী নেতা কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের ডাকে এক বৈঠকে বিরোধীরা একজোটও হয়েছিলেন। শুক্রবারও তারই পুনরাবৃত্তি ঘটে। বিরোধীরা সংসদ অচল করে দেন। আলোচনার দাবি জানিয়ে বিভিন্ন দলের নোটিশ দুই কক্ষেই সভাপ্রধানেরা খারিজ করে দিলে সভা ভন্ডুল হয়ে যায়।

বিরোধীদের বক্তব্য, বিরোধী দাবি মেনে কংগ্রেস আমলে বোফর্স (১৯৮৭), হর্ষদ মেহতা শেয়ার কেলেঙ্কারি (১৯৯২), কেতন পারেখ শেয়ার কেলেঙ্কারি (২০০১), কোমল পানীয়ে কীটনাশক কেলেঙ্কারি (২০০৩), টু জি কেলেঙ্কারি (২০১১), ভিভিআইপি হেলিকপ্টার কেলেঙ্কারির (২০১৩) তদন্তে যুগ্ম সংসদীয় কমিটি (জেপিসি) গঠিত হয়েছিল। কিন্তু বিজেপি আমলে রাফাল, পেগাসাস, লাদাখে চীনা হামলাসহ কোনো দাবিই আমলে নেওয়া হয়নি। বিরোধীরা এ কথাও বলছেন, শেয়ারবাজারে কারচুপির দুটি ঘটনার (হর্ষদ মেহতা ও কেতন পারেখ) জেপিসি গঠনের দাবিতে সবচেয়ে সরব ছিল তৎকালীন বিরোধী দল বিজেপি। আজ তারা নীরব। কারণ, তদন্ত হলেই আদানির উত্থানের পেছনে নরেন্দ্র মোদির হাত স্পষ্ট হয়ে যাবে।

প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলে গৌতম আদানির পরিচিত আজকের নয়। জনপ্রিয় ধারণা, প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদী হাত তাঁর ওপর বলে অল্প সময়ে সবাইকে ছাপিয়ে তিনি বিশ্বের তৃতীয় ধনীর স্বীকৃতি পেয়েছেন। দেশের ২২টি রাজ্যে ব্যবসা করতে পারছেন। প্রধানমন্ত্রী মোদিই আদানির স্রষ্টা। তিনিই যন্ত্রী। এ ধারণা নস্যাৎ করতে গৌতম আদানির এক বক্তব্য শুক্রবার প্রচার করা হয়, যাতে তিনি তাঁর উত্থানের একমাত্র কারণ হিসেবে মোদির হাত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। ওই ধারণা ভিত্তিহীন জানিয়ে বলেছেন, তাঁর পেশাগত সাফল্যের পেছনে কোনো ব্যক্তিবিশেষের হাত নেই।

আদানি গোষ্ঠীর সব শেয়ারের দরপতন আজ শুক্রবারও অব্যাহত রয়েছে। হিনডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্ট আসার পর থেকে আদানি সাম্রাজ্যের সম্পদ অর্ধেক কমে গেছে। শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ ১২০ বিলিয়ন বা ১২ হাজার কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের সিটি গ্রুপ ও সুইস ব্যাংক ক্রেডিট সুইসি ঋণের পরিবর্তে আদানিদের বন্ড গ্রহণ বন্ধ করে দিয়েছে। শুক্রবার তারা আরও এক ধাক্কা খেল স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরস ডাউ জোন্সের কাছ থেকে। এই ‘গ্লোবাল রেটিং’ সংস্থা ঠিক করেছে, কারচুপির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে তারা আদানি গোষ্ঠীকে তাদের টেকসই সূচক থেকে বাদ দিয়ে দেবে। বিশ্বের ধনীদের তালিকায় গৌতম আদানির স্থান এ মুহূর্তে ২২ নম্বরে।